ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

দখল-দূষণে ঐতিহ্য হারিয়েছে শ্যামাসুন্দরী

নিজস্ব প্রতিবেদক | রংপুর | প্রকাশিত: ০৩:৩৬ পিএম, ২৯ নভেম্বর ২০২৪

দখল-দূষণে ঐতিহ্য হারিয়েছে রংপুর নগরীর বুকচিরে বয়ে চলা শ্যামাসুন্দরী খাল। ময়লা, আবর্জনা ও বর্জ্য ফেলার কারণে খালটি যেমন ভরাট হয়ে গেছে তেমনি এলাকার পরিবেশও দূষিত করে ফেলছে প্রতিনিয়ত।

শত বছরের পুরনো রংপুরের শ্যামাসুন্দরী খালটির এক সময় নামের মতো রূপ আর যশ থাকলেও এখন আর নেই। নগর দূষণমুক্ত রাখতে খননকৃত এ শ্যামাসুন্দরী খাল এখন নগর দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, হয়ে উঠেছে মশার নিরাপদ প্রজনন কেন্দ্র। গত মে মাসে বেশ ঘটা করে পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করা হলেও ছয় মাসের ব্যবধানে পুরোনো রূপেই ফিরে গেছে শ্যামাসুন্দরী।

এদিকে দূষিত বর্জ্য ফেলার পাশাপাশি খাল দখলের প্রতিযোগিতাও বন্ধ হয়নি। কয়েক দফায় উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েও পুরোপুরি দখলমুক্ত হয়নি খালটি।

পরিবেশবিদরা বলছেন, খালটি দূষণ ও দখলমুক্ত করতে না পারলে নগরবাসীর দুর্ভোগ কমবে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, রংপুর জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে গত জুন-জুলাই নতুন করে শ্যামাসুন্দরী খালের জরিপ কাজ সম্পন্ন করা হয়। এতে সিএস নকশা অনুযায়ী ১১৭ জন অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করে সচিত্র প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কাছে জমা দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকেও দখল ও দূষণের প্রতিবেদন তুলে ধরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানানো হয়।

দখল-দূষণে ঐতিহ্য হারিয়েছে শ্যামাসুন্দরী

ঐতিহ্যবাহী শ্যামাসুন্দরী খাল পুনরুজ্জীবিত করতে গত ১১ মে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নকরণ ও জনসচেতনতা কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন তৎকালীন সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। একযোগে খালের পাঁচ কিলোমিটার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার মধ্য দিয়ে শ্যামাসুন্দরী পুনরুজ্জীবন ও সচল রাখার কার্যক্রমে ১৫ পয়েন্টে স্বেচ্ছাসেবী যুব সংগঠন বিডি ক্লিনের একহাজার সদস্যসহ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শাখার পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা অংশ নেন।

এ বিষয়ে রংপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে ফাতিমা জাগো নিউজকে বলেন, দূষণমুক্ত রাখতে সিটি করপোরেশন থেকে প্রতিনিয়ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করা হয়। এরপরও মানুষ সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলে পরিবেশ দূষিত করে ফেলছে।

সিটি করপোরেশন থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রজেক্ট ডিজাইন পাঠানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আংশিক কাজ এখনো বাকি আছে। খুব শিগগিরই প্রজেক্ট ডিজাইন পাঠানো হবে। মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ পেলে শ্যামাসুন্দরীর সৌন্দর্য বর্ধন ও কাঙ্ক্ষিত সংস্কার সম্ভব হবে।

স্থানীয় ইতিহাসবিদরা বলেছেন, শ্যামাসুন্দরী খাল এক সময় রংপুর শহরের লাইফলাইন ছিল। অনিয়ন্ত্রিতভাবে দখল, গৃহস্থালির বর্জ্য ফেলা ও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রাচীনতম ও রংপুরের দীর্ঘতম এই খাল এখন সরু নালায় পরিণত হয়েছে। যে খালটি পরিবেশ রক্ষার জন্য খনন করা হয়েছিল তা এখন পরিবেশ দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খালটি ১৮৯০ সালে খনন করা হয়। স্থানীয়দের মতে খালটি প্রথমে ৬০ থেকে ১০০ ফুট চওড়া হলেও এখন এটি সরু নালায় পরিণত হয়েছে। এর পানি কালো হয়ে গেছে। সঙ্গে তীব্র দুর্গন্ধ।

স্থানীয় ইতিহাসবিদদের মতে, ১৯ শতকের শেষের দিকে মশাবাহী ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবের কারণে রংপুরে অনেক লোক মারা যায়। নিহতদের মধ্যে ছিলেন রংপুরের মহারানী শ্যামাসুন্দরী। মৃত্যুর পর, তার ছেলে রাজা জানকী বল্লব মশার প্রজনন মোকাবিলায় রংপুর শহরে একটি খাল খননের উদ্যোগ নেন। খালটি খনন করে তার মায়ের নামে নামকরণ করেন। সেই থেকেই খালটি রংপুরে শ্যামাসুন্দরী খাল নামে পরিচিত।

রংপুরের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কেল্লাবন্দ এলাকায় ঘাঘট নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে পশারীপাড়া, ইঞ্জিনিয়ারপাড়া, পালপাড়া, গোমস্তাপাড়া, সেনপাড়া, তেঁতুলতলা, মুলাটোল, বৈরাগীপাড়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এ খালটি খোকসা ঘাঘট নদীতে পড়েছে।

এর পানি ছিল স্বচ্ছ। নগরবাসী সেখানে গোসল করতেন। কিন্তু, খালটি এখন মশা উৎপাদনের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে। এমনকি খালটি এখন স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দখল-দূষণে ঐতিহ্য হারিয়েছে শ্যামাসুন্দরী

সরেজমিনে দেখা যায়, শ্যামাসুন্দরী খালটি ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। অনেকেই তাদের গৃহস্থালির বর্জ্য খালে ফেলেন। এছাড়া অনেকে পাইপ দিয়ে সরাসরি খালে বর্জ্য ফেলেন। খালের দুপাশ দখল করা হচ্ছে। ফলে খালটি সরু হয়ে নালায় পরিণত হয়েছে। এছাড়া অনেক জায়গায় পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। কমেছে খালের গভীরতা। খালে জমে থাকা পানি এখন মশার প্রজননের উর্বর স্থান। অনেক জায়গায় কচুরিপানাসহ বিভিন্ন আগাছা জন্মেছে। পানি হয়ে গেছে কালো।

২০০৭ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে রংপুর জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশন খালটির দখল ও দূষণমুক্তের উদ্যোগ নিলেও শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ২০০৮-০৯ অর্থবছরে খাল সংস্কারে ১২ কোটি টাকা এবং এরপর ২০১২ সালে ২৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন না হয়ে ধীরে ধীরে তা ময়লা-আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়।

মানবাধিকার ও পরিবেশ আন্দোলনের সহ-সভাপতি মাহবুবুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, রংপুরবাসীর লাইফলাইন হচ্ছে শ্যামাসুন্দরী খাল। দখল-দূষণের কারণে এ খাল এখন পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হয়ে উঠেছে।

মাহবুবুল আলম বলেন, শ্যামাসুন্দরী সংস্কারে এর আগে বিচ্ছিন্নভাবে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। মূলত বিচ্ছিন্ন কোনো বরাদ্দ দিয়ে দৃশ্যত কোনো উন্নয়ন হবে না।

রংপুর জেলা প্রশাসক রবিউল ফয়সাল জাগো নিউজকে বলেন, অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে খুব শিগগিরই অভিযান পরিচালনা করা হবে।

জিতু কবীর/আরএইচ/এএসএম