মডেল ঘরে পচছে পেঁয়াজ, ক্ষুব্ধ কৃষকরা
ভালো দামের আশায় রাজবাড়ীতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের আধুনিক পদ্ধতির মডেল ঘরে পেঁয়াজ রেখেও পচন রোধ না হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষকরা। আধুনিক পদ্ধতির তাপ নিয়ন্ত্রিত টিন ও বাঁশ-কাঠের এই ঘরে ৬ থেকে ৯ মাস পর্যন্ত পেঁয়াজ ভালো থাকার কথা থাকলেও ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যেই ধরেছে পচন। ফলে শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই কম দামে কৃষকরা পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।
দীর্ঘদিন সংরক্ষণে ন্যায্যমূল্য পাওয়া ও আমদানি নির্ভরতা কমাতে রাজবাড়ীর দুই উপজেলায় দুই ধাপে কৃষক পর্যায়ে বিনামূল্যে ৫০টি পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণের মডেল ঘর নির্মাণ করে দেয় কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। ঘর পেয়ে কৃষকরা প্রথম পর্যায়ে খুশি হলেও পেঁয়াজ রাখার পর পচন ধরায় হতাশ তারা।
মসলা জাতীয় ফসল পেঁয়াজ আবাদে সমৃদ্ধ জেলা রাজবাড়ী। সারাদেশের প্রায় ১৬ শতাংশ পেঁয়াজ উৎপাদন হয় এ জেলায় এবং উৎপাদনে দেশের তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে রাজবাড়ী। জেলার ৫ উপজেলায় কম বেশি পেঁয়াজের আবাদ হলেও কালুখালী, বালিয়াকান্দি ও পাংশায় উল্লেখযোগ্য হারে আবাদ হয়। জেলার উৎপাদিত পেঁয়াজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় বেশিরভাগ কৃষক ভরা মৌসুমেই অল্প দামে বিক্রি করে দেন। আর অল্প সংখ্যক কৃষক নিজস্ব উপায়ে সংরক্ষণ করলেও থাকেন নানা জটিলতায়।
জানা গেছে, পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণ পদ্ধতি আধুনিকায়ন এবং বিপণন কার্যক্রম উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কৃষক পর্যায়ে বিনামূল্যে কংক্রিটের পিলারের ওপর ২৫ ফুট লম্বা ও ১৫ ফুট চওড়া বাঁশ-কাঠের মাধ্যমে ৩ স্তরের মাঁচা দিয়ে বাড়ির আঙিনায় তৈরি করে পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণ মডেল ঘর। যার প্রতিটি ঘরে খরচ হয়েছে সাড়ে ৪ লাখ টাকা। নিয়মানুযায়ী প্রতিটি ঘরে শুধুমাত্র বিদ্যুৎ বিল প্রদানের মাধ্যমে ৫ জন কৃষক যৌথভাবে প্রায় ৩শ’ মণ পেঁয়াজ রাখতে পারবেন। তবে বেশিরভাগ স্থানে একজন কৃষক পেঁয়াজ রেখেছেন।
কিন্তু এই ঘরে ৬ থেকে ৯ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করার কথা বলা হলেও পচন ধরায় ৩ থেকে ৪ মাসের বেশি রাখতে পারেননি কেউ। প্রকল্পের প্রথম দফায় রাজবাড়ীর কালুখালীতে ২০টি ও দ্বিতীয় পর্যায়ে বালিয়াকান্দিতে ৩০ টিসহ ৫০টি ঘর নির্মাণ করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। বর্তমানে পাংশায় আরও ৫০টি ঘর নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে।
কালুখালীর নজর আলী বিশ্বাস বলেন, আমার আশা ছিল এই ঘরে পেঁয়াজ পচবে না। কিন্তু রাখার ৩ মাস পরই পেঁয়াজে পচন ধরেছে। যার কারণে ওই সময় সব পেঁয়াজ বিক্রি করে দিয়েছি। আগামীতে যেন পচন না ধরে, সে ব্যবস্থা চাই। আগে বিক্রি করায় আমাদের লস হয়েছে। এখন বিক্রি করলে ভালো দাম পেতাম।
বালিয়াকান্দির কৃষক হারুন অর রশিদ বলেন, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে পাওয়া ঘরে অনেক পেঁয়াজ রাখা যায়। আমি একটি ঘর পেয়ে ৩০০ মণ পেঁয়াজ রেখেছিলাম। কিন্তু পেঁয়াজ রাখার ৩-৪ মাস পর যেভাবে ভালো থাকার কথা ছিল, সেটা হয়নি। নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, যার কারণে ১০-১৫ মণ রেখে সব পেঁয়াজ বিক্রির করে দিয়েছি। পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে পারলে এখন যেমন ভালো দাম পেতাম, তেমনি বাজারে ঘাটতি পড়তো না।
আরেক কৃষক লুৎফর রহমান বলেন, নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পেঁয়াজ রাখতে পারলে ভালো দাম পাওয়া যাবে ভেবে সরকার থেকে পাওয়া ঘরে প্রায় ৩০০ মণ পেঁয়াজ রেখেছিলাম। কিন্তু যে পরিমাণ পেঁয়াজ পচে গেছে, তাতে লাভের চেয়ে লোকসান বেশি হয়েছে। এই পচনের কারণে আশপাশে ঘর পাওয়া সব কৃষক আরও ২-৩ মাস আগে বিক্রি করে দিয়েছে। কিন্তু আমি বাড়তি লাভের আশায় এখন পর্যন্ত রেখে লোকসানে পড়েছি। বাছাই করতে গিয়ে দেখি অর্ধেকের বেশিই পচা। তাহলে ঘর বানিয়ে লাভ কী হলো?
রাজবাড়ী কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাঠ কর্মকর্তা মো. রাজিব খান জানান, পেঁয়াজ সংরক্ষণ মডেল ঘরে ৯ মাস পর্যন্ত পেঁয়াজ ভালো থাকে। ঘর পাওয়া কৃষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পেঁয়াজ সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। পেঁয়াজ ১০ ইঞ্চি পরিমাণ উঁচু ও বাতাসে জলীয় বাষ্প থাকলে ঘরে লাগানো ফ্যান চালাতে বলা হয়েছে। কিন্তু কৃষক এই দিকনির্দেশনাগুলো সঠিকভাবে পালন না করায় কিছু পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে। এতে কৃষকের গাফিলতি ছিল।
তিনি আরও বলেন, এবার তাপমাত্রার পাশাপাশি বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ অনেক বেশি ছিল। তাছাড়া বেশিরভাগ কৃষক হাইব্রিড ও উচ্চ ফলনশীল জাতের পেঁয়াজ সংরক্ষণ করেছে। এই পেঁয়াজ একটু বেশিই নষ্ট হয়। আগে কৃষকরা যে পদ্ধতিতে পেঁয়াজ রাখতো, তাতে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হতো। কিন্তু কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের দেওয়া ঘরে পেঁয়াজ নষ্ট কম হয়েছে। তবে ওজনে ৫ থেকে ৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
এফএ/জেআইএম