বগুড়া
শত বছরের পুরোনো মেলায় বিক্রি হলো দেড় হাজার মণ মাছ
বগুড়ার শিবগঞ্জে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। রোববার (১৭ নভেম্বর) উপজেলার উথলীতে বসে এ মেলা। মেলায় দেড় হাজার মণের বেশি মাছ কেনাবেচা হয়েছে বলে জানিয়েছে আয়োজক কমিটি।
মেলায় এক কেজি থেকে শুরু করে ১৫ কেজি ওজনের রুই, কাতলা, বোয়াল, ব্রিগেড, কার্পসহ হরেক রকমের মাছ বিক্রি হয়। তবে গত বছরের তুলনায় এবার মাছের দাম বেশি বলে জানিয়েছেন ক্রেতারা। বিশালাকৃতির রুই-কাতলা, বোয়াল ও বিগহেড মাছগুলো সাতশ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও মাঝারি আকারের মাছ ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। এছাড়া ২০০ থেকে ৩০০ টাকা দরে ব্রিগেড ও সিলভার কার্প মাছ বেচাকেনা হয়। শত বছরের প্রাচীন উথলী মাছের মেলাকে কেন্দ্র করে আশপাশের ২০ গ্রাম স্বজনদের মিলনমেলায় পরিণত হয়।
পঞ্জিকানুসারে রোববার ১ অগ্রহায়ণ হওয়ায় এদিন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নবান্ন উৎসব পালন করে। এ উৎসব কেন্দ্র করেই প্রতি বছর মাছের মেলা বসে উথলী হাটে। নবান্ন উপলক্ষে উথলী গ্রাম ছাড়াও পাশের রথবাড়ি, নারায়ণপুর, ধোন্দাকোলা, সাদুল্লাপুর, বেড়াবালা, শিবগঞ্জ, আকনপাড়া, গরীবপুর, দেবীপুর, গুজিয়া, মেদেনীপাড়া, বাকশন, রহবল, মোকামতলাসহ ২০ গ্রামে ছিল উৎসবের আয়োজন। প্রতিটি বাড়িতেই মেয়েজামাইসহ আত্মীয়স্বজনদের নিমন্ত্রণ করা হয়।
নবান্ন উপলক্ষে উথলী হাটে মাছের মেলা বসলেও জমি থেকে নতুন তোলা অন্যান্য শাক-সবজির পসরাও সাজানো হয় মেলা চত্বরে।
এ মেলায় নতুন আলু বিক্রি হয়েছে ৩০০ টাকা কেজি দরে। এছাড়াও মিষ্টি আলু ও কেশর (ফল) প্রতি কেজি ৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। এছাড়া ছিল নতুন শিম থেকে শুরু করে হরেক প্রকার সবজি।
বগুড়ার গাবতলী উপজেলার রামচন্দ্রপুর থেকে মেলায় মাছ বিক্রি করতে এসেছিলেন ব্যবসায়ী পটল প্রামাণিক। তিনি জানান, গত বছরের তুলনায় এবার দাম কিছুটা বেশি হলেও বেচাকেনা হয়েছে আশানুরূপ। প্রতি বছরই তিনি এ মেলায় মাছ বিক্রি করেন তিনি।
শিবগঞ্জ উপজেলার পনের টিকা গ্রামের ব্যবসায়ী এনামুল হক মেলায় দোকান দিয়েছেন। তিনি বলেন, গত বছর মেলায় যতো ক্রেতা ছিল এবার তেমনটি নেই। এবার তিনি বিক্রির জন্য রুই কাতলা বিগহেড মিলে ৮০০ কেজি মাছ এনেছিলেন। সেখানে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত তিনি ৬০০ কেজির মতো মাছ বিক্রি করেছেন। ৫০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে ৪ কেজি থেকে ৬ কেজি ওজনের রুই কাতল বিক্রি করেন।
তিনি বলেন, ৭০০ টাকা কেজি দরে ১৫ কেজির একটি কার্প বিক্রি করেছেন ১০ হাজার টাকায়। এবার মেলায় প্রতি কেজি মাছের দাম ১০০-১২০ টাকা বেশি।
মাছ বিক্রেতা অখিল চন্দ্র সরকার জানান, মেলায় ছোট-বড় মিলে শতাধিক মাছের দোকান বসেছে। প্রত্যেক বিক্রেতা ৫-১০ মণ করে মাছ বিক্রি করেছেন। মেলার এসব বিক্রেতার কাছে মাছ সরবরাহের জন্য সেখানে ২০টি আড়ৎ খোলা হয়। সেসব আড়ৎ পাইকারি দরে মাছ কিনে অধিকাংশ দোকানি মেলায় খুচরা বিক্রি করেন।
মেলায় আড়ৎ খুলে বসা মোকামতলা বাজারের ভাই ভাই মৎস্য আড়তের সত্ত্বাধিকারী শাহীন আলম জানান, অধিকাংশ আড়ৎদার পিকআপভ্যান ও ভটভটিতে করে মাছ এনে নিমিষে পাইকারি বিক্রি করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, পুরো মেলার ২০ জন আড়ৎদার মিলে কোটি টাকার ওপরে মাছ বিক্রি করেছেন। আলিয়ার হাটের একতা মৎস্য আড়তের সত্ত্বাধিকারী মোনায়েম আহমেদ এবার মেলায় ৫ ট্রাক মাছ বিক্রি করেছেন বলে জানান।
মেলায় মাছ কিনতে আসা শিবগঞ্জ পৌরসভার বানাইল মহল্লা ব্যবসায়ী মঞ্জুরুল হক জানান, উথলীর নবান্ন মেলায় বিক্রির জন্য আশপাশের এলাকার পুকুরগুলোতে সৌখিন চাষিরা মাছ মজুদ করে রাখেন। এলাকার কে কতো বড় মাছ মেলায় তুলতে পারে যেন তারই প্রতিযোগিতা চলে চাষিদের মধ্যে। এছাড়া আড়ৎদাররা তো আছেই। এলাকার লোকজনও প্রায় প্রতিযোগিতা করে তুলনামূলক বড় মাছ কিনে বাড়িতে নিয়ে যায়। মূলত সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নবান্ন উৎসব করলেও আশপাশের গ্রামের সকল সম্প্রদায়ের মানুষ কেনাকাটা করে।
উথলী গ্রামের বাসিন্দা অন্তু সাহা জানান, প্রায় শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মেলাটি যেমন মাছের জন্য বিখ্যাত, তেমনি মেলার দিন নতুন শাক-সবজিতেও ভরপুর থাকে। একারণে আশপাশের লোকজন মেলায় ছুটে আসেন। তিনি বলেন, শুধু যে মাছ আর সবজিই নয়, মেলার আবহের জন্য সেখানে নাগরদোলা, শিশু-কিশোরদের খেলনার দোকান বসেছে। সেই সঙ্গে মিষ্টান্ন ও দইয়ের একটি বড় বাজারও বসেছে মেলা চত্বরে।
উথলী বাজারের ইজারাদারের প্রতিনিধি পিয়াস হক জানান, এবার মেলায় দেড় হাজার মণের বেশি মাছ কেনাবেচা হয়েছে যার আর্থিক মূল্য দুই কোটি টাকার মতো হতে পারে। তিনি বলেন, মেলার বিষয়টি এতোটাই প্রচার পেয়েছে যে আশপাশের ২০ গ্রামের মানুষই শুধু নয় বরং বগুড়া-জয়পুরহাট শহর থেকেও অনেকে মাছ কেনার জন্য মেলায় যান।
শিবগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিনা আক্তার বলেন, নবান্নের মেলা এ এলাকার একটি বিশেষ ঐতিহ্য। গ্রামে গ্রামে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। মেলায় কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা যেন না হয় সে জন্য প্রশাসনের তরফ থেকে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
আরএইচ/এমএস