নির্যাতনের অভিযোগ
কুষ্টিয়ায় এবার সামাজিক প্রতিবন্ধী কেন্দ্র থেকে তরুণীর পলায়ন
কুষ্টিয়ায় এবার সামাজিক প্রতিবন্ধী মেয়েদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে আমেনা খাতুন নামে এক তরুণী পালিয়ে গেছেন। সরকারি শিশু পরিবার (বালক) থেকে এক শিশু শিক্ষার্থীর নিখোঁজের রেশ কাটতে না কাটতেই মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) বেলা ১১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
এ ব্যাপারে কুষ্টিয়া মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়রি (জিডি) করা হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করেও ওই নিবাসীর সন্ধান পাওয়া যায়নি।
সেখানকার কর্মকর্তা, কর্মচারী ও প্রশিক্ষকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও নিবাসীদের নির্যাতনের অভিযোগে উঠেছে। নির্যাতনের শিকার হয়ে আমেনা খাতুন সেখান থেকে পালিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন প্রশাসন, পুলিশ ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তারা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছেন। এ ঘটনায় কারো গাফিলতি থাকলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানানো হয়।
সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত সামাজিক প্রতিবন্ধী মেয়েদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রটি কুষ্টিয়া শহরতলীর বটতৈল এলাকায় অবস্থিত। সেখানে ১০০ জন নিবাসী থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে বর্তমানে মোট ২৭ জন নিবাসী আছেন৷ নিম্নমানের খাবার দেওয়া, নিবাসীদের জন্য সরবরাহকৃত মালামাল বিক্রি, শিশুদের নির্যাতনসহ নানা অভিযোগ উঠেছে কর্মকর্তা, কর্মচারী ও প্রশিক্ষকদের বিরুদ্ধে।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের ম্যানেজার নাজনীন নাহার বলেন, ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে আমেনা খাতুন নামের সামাজিক প্রতিবন্ধী ওই তরুণী এই কেন্দ্রে থাকেন৷ দিনাজপুরের একটি সেফ হোম থেকে আসা ওই তরুণীর বয়স ১৮ বছর। তার বাসা ও মা-বাবার ঠিকানা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ছোট বেলায় হয়তো হারিয়ে গিয়েছিলেন। ওই তরুণী সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন। তার পালিয়ে যাওয়ার কথা না। কিন্তু মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) বেলা ১১টার দিকে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সীমানাপ্রাচীর টপকে পালিয়ে যাওয়ার এ ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ-খবর নিয়েও কোথাও তাকে পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে কুষ্টিয়া মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়রি (জিডি) করা হয়েছে। পালিয়ে যাওয়া ওই তরুণীর সন্ধানে পুলিশের পাশাপাশি আমরা নিজেরাও খোঁজা-খুঁজি করছি। এই প্রতিষ্ঠানে কোনো অনিয়ম, দুর্নীতি ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি বলে তিনি দাবি করেন।
তবে সামাজিক প্রতিবন্ধী প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের একাধিক নিবাসী অভিযোগ করে বলেন, সরকারিভাবে দৈনিক খাবার তালিকায় যে খাবার সরবরাহের কথা, তা তাদের খেতে দেওয়া হয় না। বিপরীতে নিম্নমানের খাবার অল্প পরিমাণে দেওয়া হয়। ঠিকমতো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। দীর্ঘদিন সেখানে থাকার পরও তাদের পুনর্বাসনের বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় না। তালিকা অনুযায়ী মাছ ও মাংস খেতে দেওয়া হয় না। এছাড়া প্রায় প্রতিদিন মোটা চালের ভাত, সবজি ও পাতলা ডাল রান্না করে দেওয়া হয়। আর মাঝেমধ্যেই তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়৷ বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও নির্যাতনের প্রতিবাদ করলে তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়।
তারা বলেন, ম্যাডাম ও স্যাররা আমাদের জন্য সরকারের বরাদ্দ অনুযায়ী সরবরাহ করা মালামাল দেন না। আমাদের কাজ করতে বাধ্য করেন। না করলে আমাদের হুমকি-ধামকি দেওয়া হয়, মারধর ও নির্যাতন করা হয়। তাদের নির্যাতনের কারণেই এখান থেকে আমেনা খাতুন পালিয়েছে। আমরা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের পদত্যাগ ও শাস্তি চাই।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়া জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক আব্দুল লতিফ সেখ বলেন, আমেনা খাতুন নামের এক নিবাসী পালিয়েছেন। বিষয়টি আমরা তদন্ত করে দেখছি। অনিয়ম-দুর্নীতি ও নির্যাতনের অভিযোগটিও তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শিহাবুর রহমান শিহাব বলেন, শিশু পরিবার থেকে রিজভী এবং সামাজিক প্রতিবন্ধী প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে আমেনা খাতুন নামের দুই নিবাসী পালিয়েছে। তারা দুজনই বর্তমানে নিখোঁজ রয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তাদের খুঁজে পেতে কাজ করছে পুলিশ। এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক মো. তৌফিকুর রহমান বলেন, তরুণী নিবাসী পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। অনিয়ম-দুর্নীতি ও নির্যাতনের অভিযোগটি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখবো। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কুষ্টিয়ার বটতৈলে ১.০৫ একর জমির ওপর ২ কোটি ১১ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০০৩ সালে নির্মিত হয় সামাজিক প্রতিবন্ধী মেয়েদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রটি। ৬টি বিভাগীয় পর্যায়ের ৬টি সামাজিক প্রতিবন্ধী মেয়েদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের মধ্যে খুলনা বিভাগীয় পুনর্বাসন কেন্দ্রটি কুষ্টিয়ার বটতৈলে স্থাপিত হয়। ১০০ জনের জন্য এ পুনর্বাসন কেন্দ্রটিতে ৩ হাজার বর্গফুটের একটি অফিস, প্রশিক্ষণ ও স্কুল ভবন, একটি চিকিৎসা কেন্দ্র, ৮ হাজার বর্গফুটের দ্বিতল ডরমিটরী ভবন, ১ হাজার বর্গফুটের ২ ইউনিট স্টাফ কোয়ার্টার ও ৮০০ বর্গফুটের ২ ইউনিট স্টাফ কোয়ার্টার, ৬৭২ বর্গফুটের ওয়ার্ডার্স ব্যারাক ও পাম্প হাউজ এবং ১ হাজার ৩৭০ ফুট বিস্তৃত সীমানা প্রাচীর বেষ্টিত কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
সামাজিক প্রতিবন্ধী তরুণীদের বিভিন্ন অনৈতিক, ঘৃণিত ও বিপজ্জনক পেশা থেকে উদ্ধার করে তাদের উপযুক্ত চিকিৎসা, নৈতিক সংশোধন, শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও আর্থ-সামাজিক পূনর্বাসনের লক্ষ্যে এ পুনর্বাসন কেন্দ্রের অগ্রযাত্রা শুরু হয়।
সমাজের বিপথগামী মেয়েদের এনে প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের মাধ্যমে সমাজে পুনর্বাসন করা, মেয়েদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, অন্ন ও বস্ত্র সরবরাহ, সংশোধনী, নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করে মানসিক ও মনস্তাত্বিক উৎকর্ষ সাধন এবং একইসঙ্গে তাদেরকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার জন্য কর্ম দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। তাদের মধ্যে অনেকেই বুদ্ধি ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী রয়েছে।
এদিকে কুষ্টিয়া সরকারি বালক শিশু পরিবারে (এতিমখানা) নির্যাতনের শিকার হয়ে রায়হান হোসেন রিজভী (১২) নামের এক শিশু গত ২ নভেম্বর পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় ৪ নভেম্বর কুষ্টিয়া মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন তার স্বজনরা। ১০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পরও পালিয়ে যাওয়া ওই নিবাসীর কোনো সন্ধান মেলেনি। বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও শিশুদের নির্যাতনের অভিযোগে কুষ্টিয়া সরকারি শিশু পরিবারের (এতিমখানা) সহকারী তত্ত্বাবধায়ক ইলিয়াস হোসেন ও উপতত্ত্বাবধায়ক আসাদুজ্জামানকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। এছাড়াও এ ঘটনায় গঠিত তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত টিম অভিযুক্ত দুজনের বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতিসহ বিভিন্ন সময় শিশুদের নির্যাতন করার সত্যতা পেয়েছে। তদন্ত শেষে সোমবার (১২ নভেম্বর) তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।
আল-মামুন সাগর/এফএ/এমএস