ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

রাজশাহী

১৪৪ কোটি টাকাই পানিতে, কমেছে রেশম উৎপাদন

সাখাওয়াত হোসেন | রাজশাহী | প্রকাশিত: ০৮:৪৭ পিএম, ২০ অক্টোবর ২০২৪

দেশে রেশম চাষ ও শিল্পের সম্প্রসারণ এবং উন্নয়নে গত এক দশকে নেওয়া হয় ১৪৪ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প। কাগজে-কলমে এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন প্রায় শতভাগ দেখানো হলেও বাড়েনি রেশম সুতার উৎপাদন।

রেশম শিল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, যথাযথ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, ত্রুটিপূর্ণ সরকারি নীতি, প্রকল্প তহবিলের অব্যবস্থাপনা ও অপব্যবহার, রেশম উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও উদাসীনতা এবং সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে সম্ভাবনাময় এ শিল্প।

বাংলাদেশ রেশম চাষ বোর্ড কর্তৃক প্রদত্ত তথ্যে দেখা যায় যে, ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশে রেশম শিল্পের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে ১৯৪ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে ১৪৪ কোটি টাকার প্রকল্প এরইমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন ৪৯.৭৩ কোটি টাকা মূল্যের ‘বাংলাদেশ রেশম চাষের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা (২য় পর্যায়)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প। যার মধ্যে ৪৬ শতাংশেরও বেশি কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে বছরে রেশম সুতার চাহিদা রয়েছে ৪০০ টন। যার মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদনি করতে হয়। কিন্তু রেশম বোর্ড ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৪৯টি রেশম গুটি থেকে মাত্র এক হাজার ১৩৪ কেজি (১.১৩ টন) রেশম সুতা উৎপাদন করতে পেরেছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১.২৩ টন রেশম গুটি থেকে রেশম সুতা উৎপাদিত হয়েছিল এক হাজার ২২৯ কেজি। অর্থাৎ ১৪৪ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিলেও রেশম উৎপাদন বাড়েনি বরং কমেছে।

১৪৪ কোটি টাকাই পানিতে, কমেছে রেশম উৎপাদন

রেশম শিল্পের তিন বছরের চলমান প্রকল্প শুরু হয় ২০২১ সালের জুলাই। শেষ হওয়ার কথা ছিল চলতি বছরের জুনে। ৭৮২ টন রেশম গুটি থেকে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৫৫ টন। সেখানে উৎপাদন হয়েছে মাত্র ১.১৩ টন।

রেশম বোর্ডের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, রেশম বোর্ডের অধীনে তুঁত পাতা চাষের জমিও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪১৭ বিঘায় নেমে এসেছে, যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ৪৫০ বিঘা। কোটি কোটি টাকা খরচ হলেও উৎপাদন কমে যাওয়ায় প্রকল্পগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এ কারণ হিসেবে প্রকল্পের অর্থের অব্যস্থাপনা ও অপব্যবহারকে দায়ী করেছেন বাংলাদেশ রেশম শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি লিয়াকত আলী।

তিনি বলেন, প্রকল্পের তহবিল বিনা খরচে ব্যয় করা হয়েছে। সঠিক পরিকল্পনার অভাবে রেশম শিল্প নষ্ট হয়ে গেছে। একচেটিয়া ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে রেশম শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে তারা একাধিকবার সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে একটি উন্মুক্ত বাজার তৈরি করার আহ্বান জানান। কিন্তু তাদের অনুরোধ কোনো কাজেই আসেনি।

১৪৪ কোটি টাকাই পানিতে, কমেছে রেশম উৎপাদন

লিয়াকত আলী জানান, রাজশাহী বিসিকের ৭৬টি বেসরকারি রেশম কারখানার মধ্যে ৭০টি রেশম সুতার অভাবে বন্ধ রয়েছে। সরকার যদি বেসরকারি খাতকে রেশম সুতা উৎপাদনের অনুমতি এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয় তাহলে বাংলাদেশ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বাইরের দেশে রপ্তানিও করতে পারে। দেশে বছরে ৪৫০ টনের বেশি রেশম সুতা উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রাজশাহী জেলা শাখার সভাপতি আহমেদ শফি উদ্দিন বলেন, দেশের প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির আড্ডা ও সরকারি তহবিল লুটপাটের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো রেশম শিল্পে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু আমরা কেন পিছিয়ে আছি?

ভারতের কেন্দ্রীয় রেশম বোর্ডের তথ্যে দেখা যায়, দেশটিতে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩১৯০৬ টন থেকে উৎপাদন বেড়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩৮৯১৩ টনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক (প্রশাসন ও সম্প্রসারণ) মোহাম্মদ এমদাদুল বারী দেশের রেশম উৎপাদন কমে যাওয়ার জন্য জনবলের অভাবকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, আমরা যাদেরকে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে থাকি, তাদের অনেকেই অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির পর তুঁত পাতা চাষে অনাগ্রহী হয়ে যান।

১৪৪ কোটি টাকাই পানিতে, কমেছে রেশম উৎপাদন

এমদাদুল বারী বলেন, তারা শুধু দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের নয়, মধ্যম পর্যায়ের কৃষকদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে আরও প্রকল্প গ্রহণের পরিকল্পনা করছেন।

রেশম শিল্পের এই করুণ অবস্থার জন্য বোর্ড কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, অনিয়ম ও উদাসীনতাকে দায়ী করেন রেশম বোর্ডের সাবেক উপ-প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান।

তিনি বলেন, বোর্ডের কর্মকর্তারা শুধু তাদের দৈনন্দিন কাজ করেন। তারা কখনই বিদ্যমান সমস্যা সমাধান করা এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন না। কর্মকর্তারা দুর্নীতি ও জনসাধারণের তহবিল লুটপাটের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেন।

মো. কামরুজ্জামান অভিযোগ করেন, রেশম চাষ বোর্ডের বার্ষিক প্রতিবেদনের ৯০ শতাংশ তথ্যই ভুয়া। কারণ কর্মকর্তারা কাগজে-কলমে উৎপাদন বৃদ্ধি দেখাতে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দেখিয়েছেন।

১৪৪ কোটি টাকাই পানিতে, কমেছে রেশম উৎপাদন

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আমিনুজ্জমান সালেহ রেজা বলেন, বিপুল সম্ভাবনা ও সমৃদ্ধ-ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও সরকারের ত্রুটিপূর্ণ নীতির কারণে দেশের রেশম শিল্প ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। দেশের রেশম শিল্প ধ্বংসের জন্য শেষ পেরেকটি ছিল রাষ্ট্র পরিচালিত রেশম কারখানাগুলো বন্ধ করে দেওয়া। এছাড়া ব্যবসায়ীদের প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে নিম্নমানের রেশম আমদানির অনুমতি দেওয়া, স্থানীয় বাজারকে চীনের সস্তা রেশম সুতা ব্যবহারও এ শিল্প ধ্বংসে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।

অধ্যাপক আমিনুজ্জমান বলেন, রেশম শিল্পের বর্তমান অবস্থার পেছনে প্রধান প্রতিবন্ধকতা ছিল সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অভাব। তিনি বলেন, ‘আমরা ধরেই নিয়েছি যে, রেশম শিল্প একটি অলাভজনক খাত। যেতেতু আমরা এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে পারছি না, তাহলে বলতেই পারি আমরা সমৃদ্ধ এ শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টাই করছি না।’

উৎপাদন বাড়াতে পরামর্শ দিয়ে এই অধ্যাপক বলেন, কর্তৃপক্ষের উচিত রেশম পোকার ডিম, রেশম গুটি, তুঁত পাতা এবং রেশম সুতা উৎপাদন থেকে পুরো সিস্টেমটিকে একটি মডেল সিস্টেমে নিয়ে আসা। যেখানে কৃষকদের প্রশিক্ষণ, পর্যবেক্ষণ এবং সহায়তা করা হবে।

তিনি আরও বলেন, ‘রেশম শিল্পের জন্য উন্মুক্ত বাজার তৈরির কোনো বিকল্প নেই। কৃষকদের যদি ন্যায্যমূল্য এবং সরকারের কাছ থেকে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় ঋণ সহায়তা না দেওয়া হয়, তাহলে রেশম শিল্পকে কখনোই পুনরুজ্জীত করা সম্ভব হবে না।’

এসআর/জিকেএস