রোমানকে ছেড়ে যায় না ‘বাহাদুর’, পাহারা দেয় হাঁস-মুরগি
নাম তার ‘বাহাদুর’। নাম ধরে ডাক দিলেই সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে। কিছুক্ষণ বসে খাবার খায়, আবার চলে যায়। তবে খুব কাছাকাছিই অবস্থান নেয়। এতক্ষণ যে বাহাদুরের কথা বলা হচ্ছে এটি কোনো মানুষ নয় বরং এটি একটি বাজপাখি। ভালোবেসে এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাহাদুর’।
এই বাহাদুরের সঙ্গে গত দুই বছর ধরে সখ্য গড়ে উঠেছে রোমান ছৈয়াল নামের এক যুবকের সঙ্গে। ভালোবাসায় শিকারি পাখিকেও যে বশে আনা যায়, তার এক দৃষ্টান্ত রোমান আর বাহাদুরের বন্ধুত্ব।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রোমানের বাড়ি শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার মুলনা ইউনিয়নের বড় মুলনা এলাকায়। ছোটবেলা থেকেই পশুপাখি ভীষণ পছন্দ করতেন। অসুস্থ পশুপাখির খবর পেলেই উদ্ধার করে চিকিৎসা করান। দুই বছর আগে বাড়ির পাশের ফসলি জমিতে একটি বাজপাখি অসুস্থ অবস্থায় পেয়ে উদ্ধার করে ঘরে নিয়ে আসেন। এরপর পাখিটিকে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে নিয়ে টানা ১৫ দিন চিকিৎসা ও সেবা-শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলেন। একসময় পাখিটি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় খোলা আকাশে।
তবে পাখিটি রোমানের ভালোবাসা পেয়ে আর অন্যত্র যেতে চাইছে না। তাদের পরিবারের এক সদস্যের মতোই বেড়ে উঠছে পরম যত্ন আর ভালোবাসায়। রোমানের অনুপস্থিতিতে বাহাদুরের দেখাশোনা করেন মা হোসনে আরা বেগম ও ছোট ভাই সাইম ছৈয়াল।
পাখিটির খাবারের জন্য প্রত্যেক দিন কিনে রাখা হয় নানান রকম মাছ। আর যাতে কেউ ক্ষতি করতে না পারে সেদিকেও নজর রাখেন তারা। দিনে খোলা জায়গায় পাখিটি উন্মুক্ত রাখা হয়। কখনো আশপাশে উড়ে গেলে আবার ফিরে আসে। রাতে কখনো ঘরের কাছে আবার কখনো রোমানের কক্ষেই থাকে।
রোমান ছৈয়াল বলেন, “আমি যখন পাখিটিকে কুড়িয়ে পাই প্রায় মৃত অবস্থায় ছিল। পরে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাই। অনেকেই বলেছিল পাখিটি মারা যাবে। তবে আমি হাল ছাড়িনি। ১৫ দিন টানা চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে গেলে উন্মুক্ত করে দেই। কিন্তু এরপর ও আর যায়নি। আমি ভালোবেসে ওর নাম দিয়েছি ‘বাহাদুর’। এই নামে ডাকলেই ও সাড়া দেয় আর চলে আসে।”
প্রথম প্রথম পরিবারের অন্য সদস্যদের বিরক্তির কারণ হলেও এখন তারা পাখিটিকে মায়ায় চোখে দেখেন। রোমানের পাশাপাশি তারাও সেবাযত্ন করেন পরম মমতায়। রোমানের মা হোসনে আরা বেগম বলেন, ‘প্রথম প্রথম ও যখন পাখিটিকে নিয়ে সারাক্ষণ থাকতো, আমরা এক প্রকার বিরক্তই হতাম। একটা সময় আমরাও ওর মায়ায় পড়ে যাই। এখন বাহাদুর কী খাবে কখন খাবে এই নিয়ে আমাদের সময় চলে যায়। এককথায় ও এখন আমার সন্তানের মতো। রোমান বাড়িতে না থাকলে আমরাই বাহাদুরের খেয়াল রাখি।’
বাজপাখির সঙ্গে মানুষের এমন সম্পর্ক বিরল বলে অনেকেই করেছেন প্রশংসা। আর পাখিটি প্রতিবেশীদের ক্ষতি নয়, উল্টো তাদের হাঁস-মুরগির বাচ্চা পাহারা দেয় পাহারাদার হয়ে। আর তারাও খুশি হয়ে খাবার খেতে দেন পাখিটিকে।
স্থানীয় বাসিন্দা মনি বেগম বলেন, ‘আগে আমাদের হাঁস-মুরগির বাচ্চা ছেড়ে দিলে অন্য বাজপাখি এসে নিয়ে যেতো। অথচ ‘বাহাদুর’ আমাদের হাঁস-মুরগির বাচ্চা ছাড়লে পাশে বসে দেখাশোনা করে যাতে অন্য পাখি এসে ওদের ক্ষতি করতে না পারে। আমরাও ওকে ভালোবেসে মাছ খেতে দেই।’
রোমানের পরিবার নিজেদের জন্য খাওয়ার মাছ না রাখলেও বাহাদুরের জন্য নিয়ম করে মাছ রাখে প্রতিদিন। আর মাছওয়ালাও বাহাদুরের জন্য প্রতিদিন মাছ নিয়ে আসেন।
মাছ বিক্রেতা নাহিদ বলেন, ‘সেই দুই বছর ধরে আমি বাহাদুরের জন্য মাছ দিয়ে যাই। রোমান ভাইয়ের বাসায় তাদের জন্য খাওয়ার মাছ রাখুক বা না রাখুক, বাহাদুরের জন্য প্রতিদিন তারা মাছ কিনে রাখেন। আমিও সকাল সকাল বাহাদুরের জন্য মাছ নিয়ে আসি। যদি আমি ভুল করে নাও আসতে পারি, আমার ছোট ভাইকে দিয়ে মাছ পাঠিয়ে দেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘রোমান ভাই অন্য কোথাও চলে গেলেও মোবাইলে কল করে মাছ দিয়ে যেতে বলেন। এই যুগে এসেও মানুষের যে বনের পাখির প্রতি এতো ভালবাসা, তা রোমান ভাইকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না।’
এ বিষয়ে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ভালোবাসা আর যত্ন পেলে বন্যপাখিও হয়ে উঠতে পারে মানুষের বন্ধু। যার দৃষ্টান্ত বড় মুলনা এলাকার যুবক রোমান ও এক বাজপাখির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।
বিধান মজুমদার অনি/এসআর/জিকেএস