পাবনা
১০ বছরে আবাদি জমি কমেছে ৬ হাজার হেক্টর
• প্রতিবছর কমছে ১ শতাংশ চাষযোগ্য জমি
• এক দশকে কমেছে ৬ হেক্টর
• খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে, আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের
পাবনায় জনসংখ্যা বাড়লেও কমছে আবাদি জমি। গত এক দশকে ছয় হাজার হেক্টর আবাদযোগ্য জমি কমে গেছে। একই সময়ে জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিন লাখ। এসময়ের মধ্যে খাদ্য ঘাটতি দেখা না দিলেও জেলায় উদ্বৃত্ত খাদ্য পরিমাণ কমেছে প্রায় সোয়া লাখ টন। ভবিষ্যতে কৃষি উৎপাদন আরও হ্রাস পেয়ে তা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পাবনায় ১০ বছর আগে আবাদি জমি ছিল এক লাখ ৮৫ হাজার ৭৩৬ হেক্টর। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৭৯ হাজার ৮৬২ হেক্টরে।
কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্যমান জমির মধ্যে ৪৪ শতাংশ জমিতে ধান, ১০ শতাংশ গম, পেঁয়াজসহ মসলা জাতীয় ফসল ১১ শতাংশ, পাট ৯ শতাংশ, তেল জাতীয় ফসল ৯ শতাংশ, ডাল জাতীয় ফসল এক শতাংশ, শাক-সবজি চার শতাংশ, ফল দুই শতাংশ এবং তিন শতাংশ জমিতে অন্যান্য ফসল আবাদ হয়ে থাকে।
জেলায় খাদ্য চাহিদা ৪ লাখ ৬৯ হাজার ৪০৯ টন। সেখানে উৎপাদন হয়ে থাকে ৬ লাখ ৯০০ টন। এরমধ্যে পচে নষ্ট হওয়া, বীজ হিসেবে সংরক্ষণ করা, গুদামে নষ্ট হওয়া ও ইঁদুরে খাওয়াসহ নানা কারণে কিছু পরিমাণ খাদ্য বাদ যায়। বীজ ও নষ্ট বাদে থাকে ৫ লাখ ৩৭ হাজার ৮৮৭ টন খাদ্যশস্য। এরপরও উদ্বৃত্ত থাকে ৬৮ হাজার ৪৭৮ টন। তবে ১০ বছর আগে বার্ষিক খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকতো এক লাখ ৯২ হাজার ১৩৮ টন। সে হিসেবে গত ১০ বছরের ব্যবধানে জেলায় বার্ষিক খাদ্য উদ্বৃত্ত কমেছে এক লাখ ২৩ হাজার ৬৬০ মে.টন।
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, প্রতিবছরই বেশকিছু পরিমাণ আবাদি জমি ঘরবাড়ি নির্মাণ, ইটভাটা, রাস্তা-ঘাট, নদীভাঙনসহ নানা কারণে অনাবাদির তালিকায় চলে যাচ্ছে। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি থেমে থাকছে না। এতে বিদ্যমান জমিতে বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য খাদ্য উৎপাদন অনেকটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ছে। যদিও পাবনা খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলা হিসেবে স্থান লাভ করেছে। কিন্তু আবাদি জমি নষ্ট করার প্রবণতা না কমলে এই সাফল্য কতদিন ধরে রাখা যাবে তা নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। ফসলি জমি কমে আসার এ হার খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে জানান তারা।
জেলা পরিসংখ্যান অফিস সূত্র জানায়, ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পাবনা জেলায় জনসংখ্যা ছিল ২৬ লাখ ২৪ হাজার ৬৮৪ জন। ২০২২ সালের আদমশুমারি অনুসারে জনসংখ্যা ২৯ লাখ ৯ হাজার ৬২৪ জন। অর্থাৎ গত ১০ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে তিন লাখের বেশি। এছাড়া ১০ বছর আগে পরিবার ছিল পাঁচ লাখ ৯০ হাজার ৭৪৯টি। এখন পরিবারের সংখ্যা সাত লাখ ৪৩ হাজার ৫৫৮টি। পরিবার বেড়েছে প্রায় দেড় লাখ। ফলে তাদের জন্য ফসলি জমিতে গড়ে উঠেছে বাড়িঘর। এতে ফসলি জমির পরিমাণ আরও কমেছে। এর পাশাপাশি নদীভাঙন, ইটভাটা, ক্যানাল, সড়ক ও রেলপথের জন্যও ফসলি জমি ক্রমশ কমে যাচ্ছে।
- আরও পড়ুন
- শেরপুরে কফি চাষে সফলতার হাতছানি
সরেজমিন দেখা যায়, জেলার বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের পাশে হরহামেশাই নতুন বসতঘর তৈরি হচ্ছে। ঢাকা-পাবনা মহাসড়কের রাজাপুর গ্রামের পাশে নতুন বাড়ি করা জনৈক বারেক খন্দকার জানান, তাদের পুরোনো বাড়িতে পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেড়েছে। আবাসস্থল সংকুচিত হয়েছে। এজন্য স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে বসবাসের জন্য ফসলি মাঠে নতুন বসতঘর তৈরি করছেন।
ফসলি জমিতে এরকম নতুন বাড়ি প্রতিদিনই বাড়ছে। এর পাশাপাশি স্থানীয় তিন ফসলি জমিতে মাটিখেকোরা মাটি কেটে বিক্রি করায় তার বিরূপ প্রভাব পড়ছে এসব জমিতে।
বেড়া, সুজানগর ও ঈশ্বরদী উপজেলার বিস্তীর্ণ ফসলি জমি প্রতিবছর শিকার হচ্ছে নদীভাঙনের। ঈশ্বরদী-ঢালারচর রেলপথ ও রূপপুর আণবিক প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ করার কারণেও কয়েক হাজার বিঘা ফসলি জমি কমে গেছে।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার আমিষের চাহিদা মেটাতে মাছের উৎপাদন বাড়াতে প্রতিবছর শত শত আবাদি জমি কেটে পুকুর খনন করা হচ্ছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, আবাদি জমি রক্ষায় খুব গভীর না করে বা অল্প খনন করে ধানক্ষেতে মাছ চাষের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
- আরও পড়ুন
- ড্রাগন চাষে সফল খোরশেদ আলম
এদিকে আবাসন চাহিদার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ইটের চাহিদা। ফলে ফসলি জমিতে আশঙ্কাজনক হারে গড়ে উঠছে ভাটা। টপসয়েল (জমির ওপরের মাটি) কেটে ইটভাটায় সরবরাহের জন্য আবাদি জমি বিনষ্ট হচ্ছে। ফলে দিনদিন খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
পাবনা কৃষি গবেষণা বিভাগ সূত্র জানায়, প্রতিবছর চাষযোগ্য জমি কমছে ১ শতাংশ হারে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার অতিরিক্ত খাদ্য চাহিদা পূরণে চার ফসলভিত্তিক ফসল বিন্যাস ধারা উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। জেলার আটঘরিয়া উপজেলায় এ কার্যক্রম চালু করে ব্যাপক সাফল্য পাওয়া গেছে।
রিভারাইন পিপল পাবনার সভাপতি ড. মনছুর আলম। তিনি জানান, পাবনায় প্রতিবছর যে পরিমাণ কৃষিজমি কমছে তার অর্ধেকই যাচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে। অপরিকল্পিত ব্যবহারের ফলে ৬৫ শতাংশ জমির উর্বরা শক্তিও হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া জেলার বিভিন্ন উপজেলায় মাটি বিধ্বংসী ভেকু (খননযন্ত্র) মেশিন দিয়ে মাটি কেটে বিক্রি করায় দুই-তিন ফসলি জমি বিনষ্ট হচ্ছে।
কৃষি নগরায়ন বিশেষজ্ঞ মোশাররফ হোসেন মুসা বলেন, দেশে নগরায়ন বহুলাংশে বেড়ে যাচ্ছে। তাই কৃষিজমি রক্ষায় ভার্টিকাল ভিলেজ এখন থেকেই গড়ে তোলার পরিকল্পনা তথা গ্রামেই যেন বহুতল ভবন গড়ে তোলা হয়, সেজন্য জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করা দরকার।
তিনি আরও বলেন, যদি নগরায়ন ও শিল্পাঞ্চলের সঙ্গে সঙ্গে কৃষিজমির একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা যায়, তাহলে ফসলি জমি কমার হার অনেকাংশে কমে আসবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পাবনার উপ-পরিচালক ড. জালাল উদ্দিন জানান, প্রচলিত ফসল বিন্যাস ধীরে ধীরে তুলে নেওয়া হয়েছে। সারাবছর জমি ব্যবহারের মাধ্যমে অধিক উৎপাদনের জন্য সেচাবাদ উপযোগী উন্নত শস্য বিন্যাস চালু করা হয়েছে। চাষিরাও উন্নত শস্য বিন্যাসে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছেন। কৃষি যন্ত্রপাতি, মানসম্পন্ন বীজ ও উন্নতজাত ব্যবহার, সেচ-সারসহ সব উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জেলায় শস্য নিবিড়তা ২২৫-২৫০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ফলে আবাদি জমির পরিমাণ কমলেও নানা জাতের ফসলের আবাদ বাড়ছে।
তিনি বলেন, চাষিরা ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনে সক্রিয় হয়ে ওঠায় ফসলি জমি কমলেও আনুপাতিক হারে ফসল উৎপাদন বাড়ছে।
এসআর/জিকেএস