কীর্তনখোলা যেন একটি ডাস্টবিন
বরিশালের কোলঘেঁষে বয়ে যাওয়া কীর্তনখোলা নদী যেন ডাস্টবিনে পরিণত হয়েছে। যে যেভাবে পারছে তাদের উচ্ছিষ্ট ময়লা-আবর্জনা সরাসরি নদীতে ফেলছে। এতে সৌন্দর্য হারানোর পাশাপাশি দূষিত হচ্ছে পানি।
৪০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কীর্তনখোলা নদীর বড় একটি অংশ বরিশাল শহর ঘেঁষে রয়েছে। শহরের গোটা ড্রেনেজ ব্যবস্থার বর্জ্যযুক্ত পানি নগরীর বিভিন্ন খাল হয়ে কীর্তনখোলা নদীতে যাচ্ছে। এছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম নদীবন্দর বরিশালে অবস্থিত। যে নদীবন্দর দিয়ে অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার রুটে প্রতিদিন ছোট-বড় অর্ধশতাধিক যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল করে। এসব লঞ্চের বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থাও সরাসরি নদীতে হওয়ায় ধীরে ধীরে দূষিত হচ্ছে কীর্তনখোলার পানি।
শনিবার (১২ অক্টোবর) ভোর সাড়ে ৫টায় বরিশাল লঞ্চঘাট এলাকায় দেখা যায়, ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী তিনটি লঞ্চ বরিশাল ঘাটে ভিড়েছে। লঞ্চের যাত্রীরা ধীরে ধীরে নেমে যাওয়ার পর লঞ্চ কর্তৃপক্ষ শুরু করে তাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম। তখন দেখা যায় লঞ্চের যাত্রীদের ব্যবহৃত যত ময়লা-আবর্জনা জমা হয়েছে, তা স্টাফরা ঝাড়ু দিয়ে সরাসরি নদীতে ফেলছেন।
এরআগে শুক্রবার (১১ অক্টোবর) রাত ৮টায় লঞ্চঘাটে দেখা যায়, লঞ্চ ছাড়ার আগ মুহূর্ত থেকে যাত্রীরা তাদের ব্যবহার্য ময়লা নদীতে ফেলছেন। লঞ্চগুলো ঘুরে দেখা যায়, প্রথম শ্রেণির যাত্রীদের জন্য লঞ্চ কর্তৃপক্ষ কেবিনের সামনে ময়লার ঝুড়ি রাখলেও ডেকের যাত্রীদের জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ফলে যাত্রীদের যত্রতত্র ময়লা ফেলতে দেখা গেছে। পরে সেসব ময়লা-আবর্জনা আবার নদীতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।
বরিশাল নদীবন্দর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিপুল সংখ্যক মানুষের আনাগোনা ও ভাসমান ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় পন্টুন সংলগ্ন এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি। যাত্রীরা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত পলিথিন ও প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন সামগ্রী লঞ্চে কিংবা পন্টুনে বসেই সরাসরি নদীতে ফেলছেন। এমনকি লঞ্চগুলোকে পরিষ্কারের নামে এর স্টাফরাও সরাসরি নদীতে ময়লা-আবর্জনা ঝাড়ু দিয়ে ফেলছেন।
ডেক ও কেবিনের যাত্রীদের ব্যবহৃত প্লাস্টিক, কোমল পানীয় বোতল, পলিথিন, চিপসের প্যাকেটসহ সব ধরনের বর্জ্যও সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। ফলে সেসব ময়লা-আবর্জনা তলিয়ে যাচ্ছে পানিতে। এভাবে নদীবন্দর সংলগ্ন এলাকায় আলাদা একটি স্তর তৈরি করছে। যা চলমান ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালনার কাজেও ব্যাপক বাধার সৃষ্টি করছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সিরাজুল ইসলাম নামের লঞ্চের এক যাত্রী বলেন, ‘এভাবে ময়লা-আবর্জনা ফেললে অচিরেই নদীটি মরে যাবে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে সবাইকে যার যার স্থান থেকে সচেতন হতে হবে।’
আরেক যাত্রী শাহানাজ বলেন, ‘একসময় বরিশালে অনেক নদী-খাল ছিল। কালের পরিক্রমায় তা হারিয়ে যাচ্ছে। এখন যদি কীর্তনখোলা নদীও যে যার মতো ব্যবহার করে নষ্ট করে ফেলেন, তা অদূর ভবিষ্যতের জন্য হুমকিস্বরূপ। দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।’
ট্রলার মাঝিরা জানান, প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় লঞ্চগুলো পরিষ্কারের নামে বিভিন্ন ময়লা-আবর্জনা নদীর বুকে ফেলা হচ্ছে। কেউ নিষেধও করছে না। শীতের সময় নদীবন্দর ও আশপাশের এলাকায় পানি কমে গেলে দেখা যায় কীভাবে মাটিতে পলিথিন আটকে রয়েছে। আর তাতে পানি ও ময়লা আটকে পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী অ্যাডভেঞ্চার লঞ্চের সুপারভাইজার সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমরা যাত্রীদের জন্য প্রতিটি স্থানে ময়লার ঝুড়ির ব্যবস্থা রেখেছি, কিন্তু যাত্রীরা সেসব ঝুড়িতে ময়লা না ফেলে মাঝে মাঝে নদীতে ফেলেন। এক্ষেত্রে লঞ্চ কর্তৃপক্ষের কিছু করণীয় থাকে না। যাত্রীদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য লঞ্চে সারাক্ষণ মাইকের মাধ্যমে সতর্ক করা হয় বলেও জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, আগে লঞ্চের মধ্যে জমা ময়লা-আবর্জনা নদীতে ফেলা হলেও এখন লঞ্চঘাটে পৌঁছানোর পর লোকজন দিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে ফেলা হয়।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বরিশালের নির্বাহী প্রকৌশলী খালেদ বিন অলীদ বলেন, সবারই উচিত নদী পরিষ্কার রাখা। সাধারণ মানুষদের আরও সচেতন হতে হবে। আমরা যেন সবাই ময়লা-আবর্জনা যত্রতত্র না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে অভ্যস্ত হই।
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ ড্রেজার বেইজ বরিশালের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবদুর রাজ্জাক মিয়া বলেন, ময়লা-আবর্জনার কারণে নদী দূষিত হলে ভোগান্তিটা কিন্তু আমাদেরই বেশি হবে। আমরা চাই মানুষ নিজ থেকে ময়লা-আবর্জনা নদীতে না ফেলুক।
তবে এসব বিষয়ে বরিশাল জেলা প্রশাসন কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেবে কিনা জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক দেলোয়ার হোসেন ক্যামেরার সামনে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
শাওন খান/এসআর/জেআইএম