টাঙ্গাইলে কৃষি জমি কমলেও বাড়ছে ফসল উৎপাদন
জনসংখ্যার প্রভাবে ক্রমাগত কমছে টাঙ্গাইলের কৃষি জমির পরিমাণ। গত বছরের তুলনায় এক বছরে এ জেলায় কমেছে এক হাজার ৪২০ হেক্টর ফসলি জমি। তারপরও কৃষি বিভাগের তৎপরতায় বাড়ছে উৎপাদন। কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে চাষে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করায় ফসল উৎপাদন বাড়ছে।
জানা যায়, বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, মসজিদ-মাদরাসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্পকারখানা নির্মাণের কারণে জেলায় দিন দিন কমছে কৃষি জমির পরিমাণ। অনেক ক্ষেত্রে জলাভূমি ভরাট করেও নানা কাজে ব্যবহার হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, ২০২৩ সালে জেলায় মোট কৃষি জমির পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৪২ হাজার ৭৯ হেক্টর। এক বছরের ব্যবধানে চলতি বছর কৃষি জমির পরিমাণ হয়েছে দুই লাখ ৪০ হাজার ৬৫৯ হেক্টর। যা গত বছরের তুলনায় এক হাজার ৪২০ হেক্টর জমি কমেছে। এসব জমিতে ধান, গম, ভুট্টা, পাট, আখ, বাদাম, কলা, পেঁপে, লেবু প্রভৃতিসহ নানা জাতের সবজি ও ফল-ফলাদি চাষ হতো।
টাঙ্গাইল জেলা পরিসংখ্যান কার্যালয় জানায়, কৃষি শুমারি ২০০৮ এবং কৃষি শুমারি ২০১৯ এর কৃষি খানার মালিকানার ক্ষেত্রে নিজস্ব জমি আছে এমন খানার সংখ্যা ২০০৮ সালের অনুযায়ী পাঁচ লাখ ১১ হাজার ৬৪৯। অথচ ২০১৯ সালের কৃষি শুমারিতে এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে সাত লাখ ৯ হাজার ৬৭২। নিজস্ব জমি আছে এবং অন্যের জমিও তার পরিচালনাধীন এ রকম খানার সংখ্যা ২০০৮ সালে ছিল দুই লাখ ৩২ হাজার ১৫৪ এবং ২০১৯ সালে তা কমে হয়েছে এক লাখ ৬৭ হাজার ৪০৯। নিজস্ব জমি নেই শুধু অন্যের জমিতে চাষাবাদ করে এরকম খানার সংখ্যা ২০০৮ অনুযায়ী ৫৭ হাজার ৮৩৪টি, যা ২০১৯ সালে কমে হয়েছে ৪৩ হাজার ৬৫৩টি।
২০২২ সালে জেলার মোট গণনাকৃত জনসংখ্যা ৪০ লাখ ৩৭ হাজার ৬০৮ জন। এরমধ্যে পুরুষ ১৯ লাখ ৪৫ হাজার দুজন ও নারী ২০ লাখ ৯০ হাজার ৯৮২ জন। অথচ ২০১১ সালে জেলায় মোট জনসংখ্যা ছিল ৩৬ লাখ পাঁচ হাজার ৮৩ জন। জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ সাল অনুযায়ী জেলার পল্লি ও শহর এলাকায় বসবাসকারী জনসংখ্যার হার যথাক্রমে ৭৭.৪০ শতাংশ ও ২২.৬০ শতাংশ। এ হার ২০১১ সালে ছিল পল্লিতে ৮৪.৯২ শতাংশ এবং শহরে ১৫.০৮ শতাংশ।
কৃষি বিভাগ আরও জানায়, হারিয়ে যাওয়া কৃষি জমির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষিবান্ধব নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কৃষি জমি কমে যাওয়ায় একদিকে ফসলের অধিক উৎপাদন ও অপরদিকে এক ফসলি জমিকে একাধিক ফসলে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। পুরো কৃষি ব্যবস্থাপনারই আধুনিকায়ন করতে তারা তৎপরতা চালাচ্ছেন।
কৃষকরা জানান, গ্রামাঞ্চলে দিন দিন জনসংখ্যা বাড়ার ফলে ঘরবাড়ি তৈরির প্রয়োজন পড়ছে। একান্নবর্তী পরিবার ভাগ হয়ে যাচ্ছে। ফসলি জমির ওপর পড়ছে এর প্রভাব। এরপর কৃষিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ছোবল তো রয়েছেই। প্রতিবছর সহস্রাধিক হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। যোগাযোগ, আবাসন ও নির্মাণকাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে কৃষি জমি।
কৃষক মজনু, আব্দুল, রহমান, ইসমাইলসহ অনেকেই বলেন, বর্তমানে চরাঞ্চলে বাদাম ও কলার চাষ বেশি হচ্ছে। চরাঞ্চলে আগে বিভিন্ন সবজির আবাদ হতো। কলা ও বাদাম চাষে কৃষকের খরচ কম, লাভ বেশি। ফলে চরাঞ্চলের কৃষকরা সবজি আবাদ ছেড়ে অনেকেই কলা ও বাদাম চাষে ঝুঁকছেন। এছাড়া স্থানীয় তিন ফসলি আবাদি জমিতে কতিপয় মাটি খেকোর প্রভাব ফসলি জমিতে পড়ছে।
এই কৃষকদের দাবি, প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে নদী-নালা, খাল-বিল থেকে মাটি কেটে বিক্রির উৎসব শুরু হয়। এ অবস্থার অবসান না হলে ফসলি জমি হুমকিতে পড়বে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কর্মকর্তা বেল্লাল হোসেন বলেন, আবাদি জমির পরিমাণ কমলেও কৃষি বিভাগের নানামুখী তৎপরতায় নানা জাতের ফসলের আবাদ বাড়ছে। প্রতিবছর মিল-কারখানা গড়ে উঠায় এক থেকে দেড় ভাগ ফসলি জমি কমেছে। তবে জেলার কৃষকরা অত্যাধুনিক ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ফলে ফসলি জমি কমলেও ফসল উৎপাদন বাড়ছে।
টাঙ্গাইল জেলা পরিসংখ্যান কার্যালয়ের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. ওবায়দুর রহমান বলেন, নিজস্ব জমি আছে জেলায় এমন খানার সংখ্যা ২০০৮ এর তুলনায় ২০১৯ সালে ৩৮.৭০ শতাংশ বেড়েছে। বিভিন্ন শুমারির উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৮১ সালে জেলার শহর এলাকায় বসবাসকারী জনসংখ্যার হার ছিল ৭.৫৬ শতাংশ যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০২২ সালে ২২.৬০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অথচ দেশে শহর এলাকায় বসবাসকারী জনসংখ্যার হার ৩১.৬৬ শতাংশ।
কুমুদিনী সরকারি কলেজের সমাজ কল্যাণ বিভাগের প্রধান ডক্টর আজাদ বলেন, বছরে যে পরিমাণ কৃষি জমি কমছে- তার অর্ধেকই যাচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে। অপরিকল্পিত ব্যবহারের ফলে ৬৫ শতাংশ জমির উর্বর শক্তিও হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া জেলার বিভিন্ন উপজেলায় মাটি বিধ্বংসী ভেকু (খননযন্ত্র) মেশিন দিয়ে মাটি কেটে বিক্রি করায় ২-৩ ফসলি জমি বিনষ্ট হচ্ছে।
তিনি বলেন, মধুপুর, ঘাটাইল ও মির্জাপুর উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইটভাটা ও মাছের প্রজেক্ট করতে ভেকু মেশিন দিয়ে মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। যদিও মাছ চাষ একটি অর্থকরী প্রজেক্ট, তারপরও ফসলি জমি নষ্ট করে মাছের প্রজেক্ট করা সরকারিভাবে নিষিদ্ধ।
টাঙ্গাইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কবীর হোসেন বলেন, এ জেলায় দুই ফসলি জমির পরিমাণ বেশি। দুই ফসলি জমিতে চার ফসলের আবাদ বাড়াতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। আগে যেখানে এক ফসলি জমি ছিল- এখন সেখানে দুই ফসল আবাদ হচ্ছে। এইভাবেই জেলায় জমির পরিমাণ কমলেও ফসলের আবাদ বাড়ছে। এছাড়া দেশের অন্য জেলার তুলনায় এ জেলায় আবাদি জমির পরিমাণ কমেনি।
তিনি আরও বলেন, জেলার কৃষকরা এক ফসল চাষ করে পুনরায় ওই একই জমিতে অন্য ফসল চাষ করায় ফলন ভালো হচ্ছে। নদী তীরবর্তী চরাঞ্চলেও কৃষকরা ভালো ফসল ফলাচ্ছেন।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক শরীফা হক বলেন, জেলায় কৃষি জমির উর্বরতা নষ্ট করে এমন সব কাজ নিরুৎসাহিত করা হবে। এছাড়া, কৃষি প্রধান দেশ হিসেবে ফসল উৎপাদনের দিকে জেলা প্রশাসনের অবশ্যই আলাদাভাবে নজর থাকবে।
আরিফ উর রহমান টগর/জেডএইচ/এএসএম