বন্যা কবলিত এলাকা যেন পর্যটন স্পট
চারদিকে পানি, মাঝ দিয়ে পিচঢালা পথ। ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করলেই হিট! অথচ কেউ ভাবছেই না, এই পানির মাঝে পানিবন্দি মানুষের আর্তনাদ কতটা ভয়াবহ। গত চারদিনে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় কবলিত শেরপুরের বন্যা দুর্গত এলাকাগুলো এখন অনেকের কাছে পিকনিক স্পট হয়ে উঠেছে। দিনের যেকোন সময় বৃষ্টি থামলেই শেরপুর জেলা শহর থেকে ঝিনাইগাতী, তিনানী ও নালিতাবাড়ী সড়কে উৎসুক মানুষের বাইক, প্রাইভেটকারের জট সৃষ্টি হচ্ছে। এই যানজটের কারণে ত্রাণ নিয়ে যাওয়ার সময় স্বেচ্ছাসেবীদের পিকাপ ও ট্রাকও আটকে থাকছে।
অনেকেই আবার ফেসবুক ও ইউটিউবের জন্য কন্টেন্ট, রিলস ও শর্টস বানাতে ভিড় করছেন বন্যা দুর্গত এলাকায়। যাদের বেশিরভাগই অযাচিত প্রশ্ন করে বিরক্ত করছেন পানিবন্দিদের। এতে ক্ষুব্ধ হচ্ছেন বন্যা কবলিত এলাকার মানুষ। সোমবার (৮ অক্টোবর) দুপুরে ঝিনাইগাতীর বিভিন্ন এলাকায় এসব কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের ভিড় দেখা গেছে।
এর আগে রোববার দুপুরে ঝিনাইগাতী উপজেলার বন্যা কবলিত এলাকায় ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছিলেন স্বেচ্ছাসেবী মশিউর রহমান সজীব। বাইরে থেকে আসা বিভিন্ন এলাকার পর্যটকদের গাড়ির জ্যামে আটকা পড়েন শেরপুর-ঝিনাইগাতী সড়কের কাটাখালী এলাকায়। এ সময় তাদের ত্রাণবাহী ট্রাকটি অন্তত দশ মিনিট আটকে ছিল। পর্যটকদের গাড়ির ভিড়ের পাশেই বন্যা কবলিত এলাকার দুই নারীকে ত্রাণের অপেক্ষায় রাস্তার পাশে বসে থাকতে দেখা যায়।
এ সময় সজীব বলেন, এই সড়কটি কখনোই এতটা ব্যস্ত হয় না। প্রশস্ত রাস্তায় একাধিক গাড়ি একসঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত ও অভারটেকিং করতে পারে। অথচ বন্যা দেখতে আসা উৎসুক মানুষদের গাড়ি এলোমেলো করে রাখার কারণে এই জ্যাম সৃষ্টি হয়েছে। যার কারণে আমাদেরও আটকে থাকতে হচ্ছে।
একইসময় শেরপুরের বাইরে থেকে আসা আরও বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ত্রাণবাহী গাড়িও জ্যামে আটকে থাকতে দেখা যায়। মৈ ফাউন্ডেশনের নারী স্বেচ্ছাসেবী রাজিয়া খান বলেন, আমরা আসলেই মানুষ নই। হয়তো সুপার হিউম্যান, নয়তো জন্তু হয়ে গেছি। এই দুঃসময়েও মানুষ পানি দেখতে এসে ভোগান্তি তৈরি করছে। আমরা ঢাকা থেকে সারাদিন জার্নি করে এসেছি ত্রাণ দিতে। এখন এই রাস্তায় জ্যামে আটকে আছি। এটা আসলেই দুঃখের বিষয়। মানুষ এই দুঃসময়েও কিভাবে এত চিল করতে পারে?
দড়িকালীনগর এলাকার মজিদ মিয়া বলেন, রাস্তা তলাইয়া গেছে। বাড়ি ঘরে পানি উঠছে। না খাইয়া আছি দুই দিন ধরে। কোনো ত্রাণের খবর নাই, অথচ বাড়ির সামনের গজারমারী ব্রিজে সারাদিনই পুলাপানের ভিড়। সবাই ছবি তুলতাছে, ভিডিও বানাইতাছে। বাড়িত পানি উঠছে, বাড়ির মহিলারা বাড়ির সামনের ব্রিজে যাইয়া একটু বসবো, সেই সুযোগটাও নাই।
দাড়িয়ারপাড় এলাকার সুমন আহমেদ বলেন, আমরা না খাইয়া থাকি। আর বাড়ির সামনের রাস্তায়, ব্রিজে মানুষ পিকনিক স্পট বানাইয়া ফেলসে।
টানা চারদিনের ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে শেরপুরের পাঁচ উপজেলা। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েন দুই লাখের বেশি মানুষ। পৌনে দুই লাখ কৃষকের প্রায় পঞ্চাশ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে এবারের বন্যায়। তিন হাজার মাছের ঘের ভেসে গিয়ে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ত্রিশ কোটি টাকা। বন্যার কারণে জেলার ২৪২টি প্রাথমিক ও ৮৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জেলার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা দিয়েছে প্রশাসন।
যদিও সোমবার সকাল থেকে ঝিনাইগাতী উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে, পার্শ্ববর্তী নকলা ও নালিতাবাড়িতে এখনো বাড়িঘরে পানি রয়েছে। জেলাজুড়ে পানিবন্দিদের উদ্ধার তৎপরতা ও ত্রাণ কার্যক্রমে প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাজ করছে স্থানীয় বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা। এছাড়াও জেলার বাইরে থেকে ময়মনসিংহ, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উদ্ধার কাজ করতে ও ত্রাণ নিয়ে শেরপুরে এসেছেন।
ইমরান হাসান রাব্বী/এফএ/জেআইএম