ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

সম্পদের মতো দুর্নীতি-অনিয়মেও পাহাড় গড়েছেন সাবেক এমপি এনামুল

সাখাওয়াত হোসেন সুজন , সালাহ উদ্দিন জসিম | প্রকাশিত: ০৭:২০ পিএম, ০৭ অক্টোবর ২০২৪

সম্পদের মতোই অনিয়ম-দুর্নীতির পাহাড় গড়েছেন রাজশাহী-৪ আসনের সাবেক এমপি ও বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রকৌশলী এনামুল হক। নারী কেলেঙ্কারি, বিঘার পর বিঘা জমি দখল, অন্যের দোকান ভেঙে মার্কেট নির্মাণ, নিয়োগ বাণিজ্য এবং দলীয় পদ বাণিজ্য করে হাতিয়ে নিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, গত ১৫ বছরে ক্ষমতার প্রভাব ও নিজের সন্ত্রাসী বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে অবৈধভাবে গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। নামে-বেনামে ৫ হাজার কোটি টাকার মালিক সাবেক এমপি এনামুল। নিজের মালিকানায় ‘নর্দান পাওয়ার সল্যুউশন লিমিটেড’নামের ৫০ মেগাওয়াটের কুইকরেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট করেছেন। ঢাকার পান্থপথে এমএ টাওয়ার নামে একটি এবং আদাবরে একটি বহুতল ভবন, রাজশাহী শহরে আবাসিক বহুতল ভবন, সাহেববাজারে সিটি সেন্টার নামে আরেকটি বাণিজ্যিক বহুতল মার্কেট সাবেক এই এমপির। শহরে সাকোয়াটেক্স নামে গার্মেন্ট, নির্বাচনী এলাকা বাগমারায় ডুপ্লেক্স ভবন, ভবানীগঞ্জে বহুতল ভবনে ‘ভবানীগঞ্জ নিউ মার্কেট’ এবং সালেহা কোল্ড স্টোরেজ করেছেন। এনা প্রপার্টিজ নামে তার সারাদেশে ডেভেলপার ব্যবসাও রয়েছে। ছয় কোটি টাকারও বেশি মূল্যের বিলাসবহুল ছয়টি গাড়ি রয়েছে। তিনটি ঢাকায় ও তিনটি রাজশাহীতে ব্যবহার করেন। নানান প্রক্রিয়ায় ব্যাংকে গচ্ছিত আছে সাড়ে চৌদ্দ কোটি টাকা।

স্থানীয়রা বলছেন, এনামুলের চোখ যে জমিতে পড়েছে, তা দখল করে ছেড়েছেন। তার জমির পরিমাণ শত বিঘার ওপরে। সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে জমি দখল করে সেই জমিতে মার্কেট নির্মাণ করারও অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগের এই নেতার বিরুদ্ধে।

পাওয়ার প্ল্যান্টের নামে শত বিঘা জমি দখল

আওয়ামী লীগে সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই নেন ‘নর্দান পাওয়ার সল্যুউশন লিমিটেড’ নামের ৫০ মেগাওয়াটের কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট। বাগমারা উপজেলার মাড়িয়া ইউনিয়নের গোয়ালপাড়া গ্রামে ২০ বিঘা জমির ওপর এটি নির্মাণ করেন। পুরো প্ল্যান্টটিই চার ফসলি জমি দখল করে করেছেন। শুধু তাই নয়, ওই প্ল্যান্টের আশপাশে শত বিঘা জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হকের বিরুদ্ধে। এসব জমিতে চার ফসল করে জীবন ধারণ করতেন স্থানীয়রা। ক্ষমতার ভয়ে আগে মুখ না খুললেও এখন খুলছেন তারা।

এনামুলের চোখ যে জমিতে পড়েছে, তা দখল করে ছেড়েছেন। তার জমির পরিমাণ শত বিঘার ওপরে। সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে জমি দখল করে সেই জমিতে মার্কেট নির্মাণ করারও অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগের এই নেতার বিরুদ্ধে।

বাগমারার বাসিন্দা মো. রায়হান আলী বলেন, আমাদের জমিও ছিল সেখানে। কোনো টাকা দেয়নি। টাকা চাইতে গেলেই তিনি তার বাহিনী দিয়ে হামলা করতেন। এজন্য ভয়ে কেউ জমির টাকা চাইনি। সবই তিনি দখল করেছেন।

নাম না প্রকাশ করে স্থানীয় এক বৃদ্ধ বলেন, আমার দুই বিঘা জমি ছিল ওই বিদ্যুৎ অফিসের কাছে। তিনি সেই জমি দখল করে নিয়েছেন। কোনো টাকা দেননি। এমনকি টাকা চাইতে গেলে তিনি আমার ছেলেকে তার বাহিনী দিয়ে পিটিয়ে আহত করেছেন। ভয়ে আমি আর টাকা চাইনি।

স্থানীয়রা বলেন, প্রশাসনকে অবৈধভাবে ব্যবহার করে আর নিজের সন্ত্রাসী বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে এসব অপকর্ম করেছেন এমপি এনামুল। এরই মধ্যে তার সম্পদসহ অনিয়মের খোঁজে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।

সম্পদের মতো দুর্নীতি-অনিয়মেও পাহাড় গড়েছেন সাবেক এমপি এনামুলচোখ যে জমিতে পড়েছে তা দখল করে ছেড়েছেন এনামুল-ছবি জাগো নিউজ

বেশি টাকা আসতো নিয়োগ বাণিজ্য ও কমিশনে

নির্বাচনী এলাকার শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করতেন এমপি এনামুল। প্রতি শিক্ষক নিয়োগে ১৫-২০ লাখ টাকা দিতে হতো তাকে। এমনকি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগেও নিতেন লাখ লাখ টাকা। এই কাজে সহযোগিতা করতেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানপ্রধান বা তার অনুগত কমিটি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরি নিয়োগেও চার লাখ টাকা করে নিয়েছেন এনামুল।

স্থানীয় একাধিক শিক্ষক জানিয়েছেন, ভবানীগঞ্জ সরকারি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপালের মাধ্যমে প্রায় দেড় কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন। শিক্ষকপ্রতি ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা নিতেন। এমনকি অনুদানের টাকা এলেও আত্মসাৎ করতেন। এমন ঘটনা ঘটেছে প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই।

আমার দুই বিঘা জমি ছিল ওই বিদ্যুৎ অফিসের কাছে। তিনি সেই জমি দখল করে নিয়েছেন। কোনো টাকা দেননি। এমনকি টাকা চাইতে গেলে আমার ছেলেকে তার বাহিনী দিয়ে পিটিয়ে আহত করেছেন। ভয়ে আমি আর টাকা চাইনি।

এর বাইরেও সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দের জন্য তাকে সুনির্দিষ্ট কমিশন দিতে হতো। বাগমারা উপজেলার যে কোনো বরাদ্দ করা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বাজেট থেকেও ১০ শতাংশ কমিশন নিতেন এনামুল।

নারী কেলেঙ্কারিতেও ছিলেন এগিয়ে

গত বছরের নভেম্বরে এক তরুণীর সঙ্গে আপত্তিকর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর নারীলিপ্সু এই এমপির বিরুদ্ধে তারই এলাকায় প্রতিবাদী মানববন্ধন হয়। ভিডিওতে রাজশাহী কলেজের ছাত্রী পরিচয় দিয়ে ওই তরুণী বলেন, ‘চাকরি দেওয়ার নাম করে এমপি এনামুল হক আমাকে সাত বছর ধরে ধর্ষণ করে আসছেন। কিন্তু চাকরি দেননি।’ এমপির সঙ্গে পরিচয়ের বিষয়ে তিনি জানান, কৃতী শিক্ষার্থীদের পুরস্কৃত করার সময় তিনি এনামুল হকের নজরে পড়েন। এরপর ফোন করে প্রেমের প্রস্তাব দেন। পরে চাকরি ও বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দীর্ঘদিন অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন।

চাকরি দেওয়ার নাম করে এমপি এনামুল হক আমাকে সাত বছর ধরে ধর্ষণ করে আসছেন। কিন্তু চাকরি দেননি। কৃতী শিক্ষার্থীদের পুরস্কৃত করার সময় এনামুল হকের নজরে পড়ি।

আগেও একাধিক নারীর সঙ্গে এনামুল হকের অডিও-ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিও চ্যাটে এক নারীর উদ্দেশে অশ্লীল কথা বলতে দেখা যায় এমপিকে। এ ছাড়া এক নারী তার সঙ্গে গোপনে প্রেম ও বিয়ের তথ্য প্রকাশ করেন। এরপর এনামুল হক তাকে তালাক দিয়ে আলোচিত হন।

১৫ বছরে প্রদর্শিত আয় বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ

২০০৮ সালে রাজশাহীর বাগমারার সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুলের বাৎসরিক আয় ছিল ২০ লাখ টাকা। স্ত্রীর ছিল না কোনো আয়। তবে দুজনের শেয়ারসহ নগদ ও ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা। আর ১৫ বছরের ব্যবধানে এনামুলের বার্ষিক আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক কোটি ২৪ লাখ টাকা। স্ত্রীর বাৎসরিক আয় না থাকলেও দুজনের নামে শেয়ারসহ নগদ ও ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ রয়েছে পৌনে চৌদ্দ কোটি টাকা। অপদর্শিত অর্থের তো হিসাব নেই।

সম্পদের মতো দুর্নীতি-অনিয়মেও পাহাড় গড়েছেন সাবেক এমপি এনামুলঢাকা থেকে গ্রেফতার হন সাবেক এই এমপি-ফাইল ছবি

এর বাইরে নিজের ক্ষমতার ব্যবহার করে ব্যাংক থেকে স্ত্রীর নামে এক হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেননি।

নির্বাচনী এলাকার শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করতেন এমপি এনামুল। প্রতি শিক্ষক নিয়োগে ১৫-২০ লাখ টাকা দিতে হতো তাকে। এমনকি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগেও নিতেন লাখ লাখ টাকা। এই কাজে সহযোগিতা করতেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানপ্রধান বা তার অনুগত কমিটি।

রাজশাহী-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক সম্প্রতি ঢাকা থেকে গ্রেফতার হয়েছেন। তাই তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান বলেন, হলফনামার প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। সঠিক তথ্য আসছে না। দুদককে কাগজে কলমে না রেখে প্রকৃত পক্ষে শক্তিশালী না করা পর্যন্ত এধরনের অনিয়ম থেকে মুক্তি মিলবে না।

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রাজশাহীর সমন্বয়ক মিজানুর রহমান বলেন, স্বাধীন কমিশন গঠনের পাশাপাশি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে। যাতে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

এসইউজে/এসএইচএস/এএসএম