সক্রিয় সিন্ডিকেট
কেরু কোম্পানি থেকে অভিনব কায়দায় মদ চুরি
চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় অবস্থিত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান কেরু অ্যান্ড কোম্পানি। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ফরেন লিকারসহ (মদ) এ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন মালামাল চুরি, গায়েব ও নানা অনিয়মই যেন এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ নামমাত্র তদন্ত কমিটি করে দোষীদের সাময়িক শাস্তি দিলেও কিছুদিন পর তারা আবার সেই কারবার করে বহাল তবিয়তে থেকে যান। ফলে তৈরি হয়েছে সিন্ডিকেট। গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পরও সিন্ডিকেটটি থেমে নেই।
আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে আবারও সক্রিয় হয়েছে চক্রটি। এবার ডিস্টিলারি বিভাগের এক ইলেক্ট্রিশিয়ানের যন্ত্র রাখা বাক্সে (টুল বক্স) মিললো ৬ বোতল ফরেন লিকার ও দুটি খালি বোতল। গত ৩০ সেপ্টেম্বর দুপুরে ডিস্টিলারি এরিয়ার পাম্প হাউজের পাশ থেকে এগুলো উদ্ধার হয়।
বিষয়টি প্রথমে ধামাচাপা থাকলেও পরে জানাজানি হয়ে যায়। এরপর নড়েচড়ে বসে কর্তৃপক্ষ। গত জুনেও ১৩ হাজার লিটার ডিএস স্পিরিট গায়েব হওয়ার অভিযোগও উঠেছিল ডিস্টিলারি বিভাগে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর মধ্যে একমাত্র লাভজনক প্রতিষ্ঠান চুয়াডাঙ্গার কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড। এটি একটি সমন্বিত কারখানা। এখানে চিনি, ভিনেগার, হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ বিভিন্ন ধরনের স্পিরিট ও দেশি-বিদেশি মদ উৎপাদন করা হয়। মূল পণ্য চিনি হলেও কোম্পানিকে বাঁচিয়ে রেখেছে ডিস্টিলারি পণ্য মদ। সেই লাভের খাত কেটে মঝে মধ্যেই ঘটে চুরির ঘটনা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে চোরাই মদসহ একের পর এক গ্রেফতারের ঘটনা ঘটলেও কেরু প্রশাসন চুরি ঠেকাতে অনেকটাই নির্বিকার বলে অভিযোগ রয়েছে।
- আরও পড়ুন:
- মদ বিক্রিতে কেরুর রেকর্ড, এক বছরে লাভ ১৫২ কোটি
- কেরু থেকে মদ তৈরির ১৩ হাজার লিটার স্পিরিট গায়েব!
নাম প্রকাশে কোম্পানিটির কয়েকজন জানান, আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষেও বিপুল পরিমাণে মদ চুরির আশঙ্কা রয়েছে। কারণ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় এই উৎসব ঘিরে কেরুর ফরেন লিকারের চাহিদা থাকে তুঙ্গে।
কয়েকজন জানান, ডিস্টিলারি বিভাগের কর্মকর্তারা শ্রমিক ইউনিয়ন নেতাদের যোগসাজশে সুযোগ বুঝে শ্রমিকদের দিয়ে এই চুরির ঘটনাগুলো ঘটান। যেটা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই বেশি হয়েছে।
এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক (ডিস্টিলারি) রাজিবুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারি ডিস্টিলারি বিভাগে আব্বাস আলী নামের একজন ইলেকট্রিশিয়ান তার টুল বক্সের ভেতর ছয়টি ফরেন লিকারের বোতল নিয়ে চুরির চেষ্টা করছেন। তাৎক্ষণিকভাবে আমি, আমাদের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইউসুফ আলীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ঘটনাস্থলে যাই। এসময় টুল বক্স ভেঙে ছয়টি ফরেন লিকার এবং দুটি খালি বোতল উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ওই কর্মীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, পুরো ডিস্টিলারি বিভাগ সিসিটিভি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। নিরাপত্তার বিষয়ে আমরা শতভাগ সতর্ক রয়েছি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৩১ আগস্ট কেরুর প্রধান ফটক থেকে ১০০ লিটার দেশি মদসহ ট্রাকচালক সাইফুল ইসলাম ও তার দুজন সহকারীকে গ্রেফতার করে দর্শনা থানা পুলিশ। আর ১৫ জুলাই রামনগর থেকে ৪০ লিটার দেশি মদসহ বাদল শেখ নামের এক মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি দর্শনা পৌর এলাকার আনোয়ারপুরে অভিযান চালিয়ে কেরুর তৈরি ৭৫০ মিলিলিটার পরিমাপের সাত বোতল বিলাতি মদসহ দুজনকে আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এছাড়া ২০২৩ সালের ২৩ অক্টোবর রাতে চুয়াডাঙ্গার লোকনাথপুরে তল্লাশিতে কেরুর একটি কাভার্ডভ্যানে ১০ লিটার দেশি মদ পায় ডিবি। এই মদ ব্যারেল থেকে চুরি করা হয়েছিল বলে ওইসময় জানায় পুলিশ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেরু অ্যান্ড কোম্পানির একজন কর্মচারী জাগো নিউজকে জানান, চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি চার বোতল বিলাতি মদসহ কেরুর পরিবহন বিভাগের চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক রকি হোসেন নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে ধরা পড়েন। সেযাত্রায় কিছুই হয়নি তার। এরপর গত ১৩ আগস্ট রাতে ডিস্টিলারির গুদামের ভেন্টিলেটর দিয়ে ১৩ নম্বর ভ্যাটে (মদ রক্ষণাগার) পাইপ লাগিয়ে দেশি মদ চুরির চেষ্টা করেন তিনি। এরপর পুলিশ তাকে আটক করলেও ‘অদৃশ্য’ কোনো কারণে পার পেয়ে যান।
ওই ব্যক্তি আরও বলেন, গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এরকম চুরির ঘটনার শেষ নেই। কিছু ঘটনা সামনে এসেছে, তাই সবাই জেনেছে। কিন্তু বেশিরভাগ চুরিই অধরা। এর পেছনে চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সাবেক এমপি আলী আজগর টগর এবং তার ভাই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলী মুনছুর বাবুসহ আওয়ামী লীগের দলীয় লোকজনের মদদ ছিল। এ কারণে দিনের পর দিন রাষ্ট্রীয় সম্পদ তছরুপ করেছে এই সংঘবদ্ধ চোরচক্র।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোম্পানি থেকে পণ্যাগারগুলোতে দেশি মদ পাঠানোর সময় ব্যারেলের মুখে যে নিরাপত্তা সিল লাগানো হয়, গাড়িতে পরিবহনের সময় চালক ও সহকারীরা সেটি খুলে মদ বের করে নেন। এরপর আগে থেকে সংগ্রহ করা সিল লাগিয়ে দেন। মদ চুরি বন্ধে পণ্যাগার থেকে ফেরা পরিবহন কোম্পানির পক্ষ থেকে এর আগে তল্লাশি চালানো এবং চোরাই মদ উদ্ধার করা হলেও নানামুখী চাপে তা বন্ধ হয়ে গেছে।
এসব বিষয়ে জানতে দর্শনা কেরু অ্যান্ড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাব্বিক হাসানের সঙ্গে দেখা করতে তার কার্যালয়ে গেলে তিনি ছুটিতে থাকায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
অভিযোগের বিষয় অভিযুক্ত আব্বাস আলীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে থাকায় সাবেক এমপি আলী আজগর টগর এবং তার ভাই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলী মুনছুর বাবুর ব্ক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
প্রসঙ্গত, ১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত কেরু অ্যান্ড কোম্পানি চিনি উত্পাদন করলেও এর রয়েছে ডিস্টিলারি, কৃষি খামার, পরীক্ষামূলক খামার ও জৈব সার কারখানা। এখানে ৯টি ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ উৎপাদন করা হয়। সেগুলো হলো ইয়েলো লেবেল মল্টেড হুইস্কি, গোল্ড রিবন জিন, ফাইন ব্র্যান্ডি, চেরি ব্র্যান্ডি, ইম্পেরিয়াল হুইস্কি, অরেঞ্জ কুরাকাও, জরিনা ভদকা, রোসা রাম এবং ওল্ড রাম।
হুসাইন মালিক/এসআর/এএসএম