জন্মান্ধ গফুর মল্লিকের শেষ জীবনে চাওয়া একটি দোকান
জন্মান্ধ হয়েও নেন না কারও দান। কখনো ভিক্ষা করেননি। জীবনযুদ্ধে ৭৬টি বছর পার করেছেন গ্রামে গ্রামে ও ট্রেনে হকারি করে। কিন্তু বয়সের ভারে শরীর এখন আর চলে না। এখন চাওয়া শুধু একটি দোকান। যেখানে বসে পার করে দিতে চান জীবনের বাকিটা সময়।
বলছিলাম রাজবাড়ী সদর উপজেলার পাঁচুরিয়া ইউনিয়নের খোলাবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল গফুর মল্লিকের কথা। যিনি জন্মান্ধ। দাম্পত্য জীবনে তার কোনো সন্তানাদি নেই। বড় ভাই কেরামত মল্লিকের ছেলে বাতেন মল্লিককে নিজের ছেলের মতো করে লালন-পালন করেছেন।
অদম্য ইচ্ছাশক্তির ফলে দরিদ্রতাকে পেছনে ফেলে মাত্র ১৬ বছর বয়স থেকে নিজের উপার্জন দিয়ে চলতে শুরু করেন আব্দুল গফুর। বর্তমানে তার বয়স ৭৭। এ বয়সেও তিনি দরাজ কণ্ঠে নারিকেলের নাড়ু, টেস্টি হজমি, চকলেট, বাদাম ভাজা বলতে বলতে টিনের বাক্স নিয়ে বেরিয়ে পড়েন গ্রামে। কখনো কখনো তাকে এসব বিক্রি করতে দেখা যায় ট্রেনেও।
সরেজমিন দেখা যায়, টিনের নড়বড়ে ছাপরায় বসবাস করেন গফুর-নুরজাহান দম্পতি। পাশেই রয়েছে ছেলের মতো করে লালন-পালন করা বাতেন মল্লিকের আরেকটি ছাপরা ঘর। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে গফুর মল্লিকের শরীর। ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। কিছুটা পথ হাঁটতে তার সময় লাগে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
স্থানীয় শামসুল আলম, সুজন ও হালিমা জানান, গফুর মল্লিক কখনো কারও কাছ থেকে কিছু নেননি। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যবসা করে এতদিন সংসার চালিয়েছেন। কিন্তু এখন তার অনেক বয়স হয়েছে। যে কারণে ভালোভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। এ মুহূর্তে তার সাহায্য খুবই প্রয়োজন। তিনি নিজেও এখন সাহায্য নিতে রাজি হয়েছেন। একটি দোকান করে দিলে বসে বসে ব্যবসা করে শেষ জীবন পার করে দিতে পারতেন।
গফুর মল্লিকের স্ত্রী নুরজাহান বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী জন্মান্ধ। বাড়িতে তৈরি করা নাড়ু ও ভাজা বাদাম নিয়ে ট্রেনে বিক্রি করেন। কিন্তু এখন বয়স হয়ে যাওয়ায় ভালোভাবে চলতে ফিরতে পারেন না। এখন কেউ যদি টাকা-পয়সা দিয়ে একটি দোকান করে দিতো, তাহলে ভালো হতো। দোকানে বসেই আমার স্বামী ব্যবসা করতে পারতেন।’
কথা হয় গফুর মল্লিকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘জন্মান্ধ হলেও সামান্য চোখে দেখি। এ অবস্থায় ১৬ বছর বয়সে আমাকে অনেকেই গাড়িতে গাড়িতে হাত পেতে ভিক্ষা করতে বলে। কিন্তু ধর্মে ভিক্ষা করা নিষেধ জেনে সেটা করিনি। তখন আমার বাবা বলেন, তিনি মারা গেলে আমি কীভাবে চলবো? তখন বলেছিলাম আমাকে আল্লাহ চালাবে। এরপর পাঁচ সিকি (২৫ পয়সায় এক সিকি) দিয়ে ৫ প্যাকেট বিড়ি কিনে বিক্রি করি এবং পাঁচ আনা লাভ করি। পরে ফেরি করে বিড়ি, সিগারেট, বিস্কটু, চানাচুর, পাপড়, গুল বিক্রি করতে থাকি। তাতে লাভও হতে থাকে। এরপর থেকে গ্রামে গ্রামে বাদাম, টেস্টি হজমি, চকলেট ও নিজের তৈরি নাড়ু বিক্রি করলেও ট্রেন চালুর পর থেকে এসব ট্রেনে বিক্রি করি।’
তিনি বলেন, ‘নাড়ু তৈরি ও বাদাম ভাজাসহ সব কাজে আমার স্ত্রী সহযোগিতা করে। কিন্তু এখন আগের মতো আর চলতে পারি না। কিছুদিন আগে ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। যে কারণে এখন কেউ কোনো সাহায্য করলে নিই। এখন কেউ যদি একটি দোকান করে দিতো, তাহলে শেষ জীবনটা এখানে বসেই কাটাতাম।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজবাড়ী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রবিউল আলম বলেন, আব্দুল গফুর জন্মান্ধ। এরআগে তাকে আমরা সহযোগিতা করতে চাইলেও তিনি নেননি। সাম্প্রতিক সময়ে জেনেছি তার একটি দোকানের প্রয়োজন। উপজেলা প্রশাসন থেকে তাকে দোকান করে দেওয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।
এসআর/জিকেএস