মিরসরাইয়ের পর্যটন থেকে কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা
সম্ভাবনাময় চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের পর্যটন শিল্প। এখানে রয়েছে প্রাকৃতিক পাহাড়ি ঝরনা, লেক, সমুদ্রসৈকতসহ একাধিক পর্যটন স্পট। প্রতিদিন এসব সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন শত শত ভ্রমণপিপাসু। তবে পর্যটকদের জন্য নিরাপত্তা ও থাকার ভালো ব্যবস্থা না থাকায় সমস্যায় পড়তে হয় অনেককে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা গেলে সরকার এ খাত থেকে প্রতি বছর কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে পারবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম উত্তর বনবিভাগের মিরসরাই রেঞ্জের গোভানিয়া বিট এলাকায় অবস্থিত মহামায়া সেচ প্রকল্প ও বোটানিক্যাল গার্ডেন এবং বড়তাকিয়া বিট এলাকার খৈয়াছড়া ঝরনার পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বনবিভাগ দুটি প্রকল্প হাতে নেয়।
২০১৭ সালে প্রস্তাবিত এ প্রকল্পে খৈয়াছড়া ঝরনার জন্য ছিল জীববৈচিত্র রক্ষা, প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার ও পর্যটক টানতে ২৫ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প। আর মহামায়ার জন্য ছিল ঝুলন্ত সেতু, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, পিকনিক স্পট ও জীববৈচিত্র রক্ষার্থে ২৬ কোটি ৭০ লাখ টাকার প্রকল্প। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে এ দুটি প্রকল্প প্রস্তাবনার মধ্যেই আটকে আছে। এ দুটি জোনে অর্ধশত কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা থাকলেও আমলাতান্ত্রিক জটে বিন্দুমাত্র অগ্রগতি হয়নি।
খৈয়াছড়া ঝরনায় আসা পর্যটকদের জন্য পার্কিং নির্মাণ, যাতায়াতের জন্য স্থানীয় প্রতাপ নারায়ন সড়কে মাটির কাজ, পার্কের প্রাকৃতিক বিবরণ সংক্রান্ত জরিপ, ২০০ হেক্টর সাইকাস উদ্ভিদ বনায়ন, ফলজ বৃক্ষরোপণ, সৌন্দর্যবর্ধন ও ৬০০ হেক্টর জমি বনায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এছাড়া প্রচার ও প্রকাশনার উদ্যোগ গ্রহণ, আবাসিক ও ফাংশনাল ভবন নির্মাণ, যাতায়াতের সড়কে ৫টি আরসিসি বক্স কালভার্ট নির্মাণ, আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল, গাইড ওয়াল, ঝরনায় যাতায়াতের সুবিধার্থে আরসিসি সড়ক ও সিঁড়ি নির্মাণ, পর্যটকদের ব্যবহারের জন্য ৫টি শৌচাগার ও ওয়াশরুম নির্মাণ, ঝরনা এলাকায় ময়লা-আবর্জনা অপসারণে পথে পথে ডাস্টবিন স্থাপন, পাহাড়ের পাদদেশে পায়ে হাটার পথ তৈরি, তিনতলা বিশিষ্ট পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ, প্রধান ফটক ও টিকেট কাউন্টার নির্মাণ, তথ্যকেন্দ্র, আরসিসি বেঞ্চ, ছাতা বেঞ্চ, আরসিসি প্লাটফর্ম, নিরাপত্তার জন্য আরসিসি বাউন্ডারি ওয়াল, পার্কিং ও সড়কের জন্য ১৫ ডিসিমেল জমি অধিগ্রহণ, স্টিল স্ট্রাকচার নির্মাণ, ফুল বাগান, সাইনবোর্ড স্থাপন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে তিনটি গভীর নলকূপ স্থাপন, দুই কিলোমিটার এলাকায় বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপন ও কেন্দ্রীয় পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন রয়েছে প্রকল্পজুড়ে।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের নাগাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ পায়, খৈয়াছরা ঝরনার রূপ লাবণ্য অবয়ব। সে থেকে দেশের নানা প্রান্ত থেকে পর্যটক আসা শুরু করে এখানে। বন বিভাগের হিসাবে প্রতিদিন এখানে দুই হাজার পর্যটক যাতায়াত করেন। তবে গত কয়েক বছরে তিনজন পর্যটক ঝরনা থেকে পা ছিটকে নিচে পড়ে মারা যান। ২০১৬ সালের শেষের নাগাদ ঢাকা থেকে আসা দুই পর্যটক পাহাড়ের চূড়ায় আটকে গেলে পরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্মীরা উদ্ধার করেন। এছাড়া ঝরনা এলাকার পাহাড়ি নির্জন স্থানে কয়েকজন পর্যটক ছিনতাইয়ের শিকার হন। শ্লীলতাহানির শিকার হন কয়েকজন নারী পর্যটক।
এদিকে ২০১০ সালের ২৯ ডিসেম্বর সেচ প্রকল্প হিসেবে উদ্বোধনের পর থেকে দেশের নানা প্রান্ত থেকে পর্যটক আসা শুরু করে মহামায়া লেক এলাকায়। এরপর সরকারের বনবিভাগ এখানে স্থাপন করে বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকো-পার্ক। গত কয়েক বছরের কিছু উন্নয়ন কাজ করেছে সরকারের এ বিভাগটি। তবে পর্যটকদের জন্য বিশুদ্ধ খাবার পানি, ওয়াশরুম, পিকনিক সেট, অবকাশ যাপন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় নানামুখী সংকট এখানে বিদ্যমান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাহাড় ও সমুদ্রবেষ্টিত এই উপজেলায় রয়েছে আট স্তর বিশিষ্ট খৈয়াছড়া ঝরনা, রূপসী ঝরনা, নাপিত্তাছড়া ঝরনা, মহামায়া ঝরনা, সোনাইছড়া ঝরনা, বোয়ালিয়া ঝরনা ও বাওয়াছড়া হরিনাকুন্ড ঝরনা, মহামায়া লেক, বাওয়াছরা লেক, মুহুরী প্রজেক্ট, ডোমখালী সমুদ্র সৈকত।
প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শত শত ভ্রমণ পিপাসু ছুটে আসেন এখানে। কিন্তু অবকাঠামো উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও থাকা-খাবারের সু ব্যবস্থা না থাকায় ভোগান্তির শিকার হতে হয় পর্যটকদের।
এদিকে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বিভিন্ন পর্যটন স্পটে দর্শনার্থী কমে গেছে। এখনো বেশ কয়েকটি ঝরনায় ঠিকাদারের লোকজন দায়িত্ব পালন করতে পারছে না।
চট্টগ্রাম উত্তর বনবিভাগ বারৈয়াঢালা রেঞ্জের আওতাধীন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য পাঁচটি ঝরনা ইজারা পেয়েছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শোমোশন লিমিটেড।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা তন্ময় ইসলাম জানান, চলতি মৌসুমে আমাদের প্রতিষ্ঠান ভ্যাটসহ প্রায় ৪০ লাখ টাকা দিয়ে বারৈয়াঢালা রেঞ্জের আওতাধীন পাঁচটি ঝরনা ইজারা নেয়। কিন্তু ভয়াবহ বন্যার কারণে অনেকদিন পর্যটক আসেনি। এখন আমাদের লোকজন দায়িত্ব পালন করতে পারছে না।
তরুণ উদ্যোক্তা রাসেল আরমান বলেন, মিরসরাই উপজেলা পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকা। সরকার যদি এসব পর্যটন স্পটে রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামো উন্নয়ন করে তাহলে পর্যটক অনেক বেড়ে যাবে। আমি বিশ্বের অনেক দেশে গিয়েছি, ওখানকার পর্যটনকেন্দ্র থেকে আমার এলাকার পর্যটন স্পটগুলো অনেক সুন্দর। শুধু উদ্যোগ প্রয়োজন। এসব পর্যটন স্পট থেকে সরকার বছরে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে পারবে।
চট্টগ্রাম উত্তর করেরহাটের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মোহাম্মদ হারুন অব রশীদ বলেন, উপজেলার অন্যান্য পর্যটন স্পটের চেয়ে মহামায়া ইকোপার্কে দৃশ্যমান অনেক কাজ হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে তথ্যকেন্দ্র নির্মাণ, পিকনিক স্পট নির্মাণ ও গেট নির্মাণ। আশা করছি আগামী বছরের মধ্যে সব কাজ শেষ করা যাবে।
এম মাঈন উদ্দিন/জেডএইচ/এমএস