ভিটেমাটি নেই, গুলিতে মারা যাওয়া রাসেলের দাফন হয় চাচার জমিতে
৫ আগস্ট বিকেলে গাজীপুরের মাওনা চৌরাস্তা এলাকায় বিজিবির পোশাক পরা ভারতীয়দের আটক করেছে স্থানীয় লোকজন—এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে ভগ্নিপতির সঙ্গে সেখানে যান রাসেল মিয়া। ঘটনাস্থলের কাছাকাছি যেতেই গুলি ছোড়ে বিজিবি। এসময় একটি বুলেট রাসেলের মাথার একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্যপাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। মুহূর্তেই রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন রাসেল।
পাশে থাকা ভগ্নিপতি শামীম মিয়াসহ আশপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে পাশের হাসপাতালে নিয়ে যান। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় রাসেলকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালে। পরে সেখানে রাত ১১টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
গাজীপুরের মাওনায় একটি ভ্যানগাড়িতে হেলপারের কাজ করতেন রাসেল মিয়া (১৯)। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ভরণপোষণের জন্য কিশোর বয়স থেকেই এ কাজে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।
ওইদিন রাতেই মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার বাউসী ইউনিয়নের সুসং ডহরপাড়া গ্রামে। নিজেদের জায়গা-জমি না থাকায় সকালে জানাজা শেষে চাচার জায়গায় দাফন করা হয় রাসেলকে।
নিহত রাসেল বারহাট্টা উপজেলার সুসং ডহরপাড়া গ্রামের মুন্সি মিয়ার ছেলে। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন তিনি।
গ্রামে ভিটেমাটির জায়গাটুকুও নেই মুন্সি মিয়ার। তাই রোজগারের জন্য এক যুগ আগে গাজীপুরের মাওনা এলাকায় চলে যান পরিবার নিয়ে। সেখানে গিয়ে মুন্সি মিয়া দিনমজুরি কাজ শুরু করেন। তার স্ত্রী শ্রমিকদের সহকারীর (জোগালি) কাজ করে ছেলে-মেয়েদের বড় করেন। তবে ছোট ছেলে রাসেলের জন্মের পর মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন মুন্সি মিয়া। এতে তার রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। এরমধ্যে মেয়েকে বিয়ে দেন। বড় ছেলে বিয়ের পর মাওনা এলাকাতেই আলাদা বাস শুরু করেন। কাজও করেন মাওনা এলাকার একটি কারখানায়।
মুন্সি মিয়ার মেয়ের স্বামী মোরগের গাড়ির (ভ্যানে করে দোকানে দোকানে মুরগি সরবরাহ করা) চালক শামীম মিয়া। পরিবার চালাতে তাই বাধ্য হয়ে কিশোর বয়সেই ভগ্নিপতি শামীমের মোরগের গাড়িতে হেলপারের কাজ নেন রাসেল। রোজ ৬০০ টাকা বেতনে বাবা-মাকে নিয়ে ভালো চলছিল তাদের সংসার। কিন্তু ৫ আগস্ট বিজিবির ছোড়া গুলিতে মারা যান রাসেল।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ছেলেকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন রাসেলের বৃদ্ধ বাবা-মা। কীভাবে চলবে তাদের বাকি জীবন? কে করবে দেখাশোনা? খাবার, চিকিৎসা খরচইবা দেবে কে—এসব চিন্তায় দিশোহারা পরিবারটি।
নিহত রাসেল মিয়ার ভগ্নিপতি শামীম মিয়ার (৩০) বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশালে। থাকেন গাজীপুরের মাওনা চৌরাস্তা এলাকায়। মোরগের ভ্যান গাড়ি চালান তিনি।
শামীম মিয়া বলেন, ‘রাসেলের বড় ভাই কাওছার বিয়ের পর সংসার নিয়ে আলাদা হয়ে গেছেন। তাই বাবা-মায়ের দেখাশোনা ও ভরণপোষণের ভার রাসেলের ওপর পড়ে। ৫-৬ বছর ধরে আমার গাড়িতে হেলপার (সহকারী) হিসেবে কাজ করে রাসেল। রোজ ৬০০ টাকা পেতো। এতে ভালোই চলে যেতো সংসার। ৫ আগস্ট বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে মাওনা চৌরাস্তা এলাকায় বিজিবির পোশাকে ভারতীয় বাহিনীর লোকজনকে ছাত্রজনতা ঘিরে রেখেছে—এমন খবর শুনে রাসেল আর আমি দেখতে যাই। কাছাকাছি যেতেই গুলি ছোড়ে বিজিবি। গুলিতে অসংখ্য মানুষ রাস্তায় লুটিয়ে পড়তে থাকে। অনেকের মতো রাসেলও লুটিয়ে পড়ে। কিছুটা শান্ত হলে দৌড়ে গিয়ে রাসেলকে উদ্ধার করি। একটি গুলি তার মাথার একপাশে লেগে অপরপাশ দিয়ে বের হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘দ্রুত তাকে পাশের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাই। অবস্থা গুরুতর দেখে উন্নত চিকিৎসার জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান চিকিৎসক। তখনই একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে মমেক হাসপাতালে রওনা হই। মমেকে নিয়ে চিকিৎসা শুরু করা হলে রাত ১১টার দিকে মৃত্যু হয় রাসেলের। রাতেই মরদেহ নিয়ে গ্রামের বাড়ি রওনা হই। পরদিন সকালে জানাজা শেষে দাফন করা হয়। যেহেতু গ্রামে রাসেলদের কোনো ভিটেমাটি নেই, তাই তার চাচার জায়গাতেই দাফন করা হয়।’
শামীম মিয়া বলেন, ‘রাসেলের রোজগারেই তার বাবা-মার খাওয়া, চিকিৎসাসহ সব ভরণপোষণ চলতো। রাসেল নেই, এখন তাদের দেখাশোনার কেউ রইলো না। এখন আমি তাদের দেখাশোনা করছি। নিজেও গরিব মানুষ, কষ্ট করে চলি। আল্লাহই একমাত্র রিজিকের মালিক।’
রাসেলের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা সহায়তা দিয়েছেন বারহাট্টা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। এছাড়া জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ডা. আনোয়ার হোসেন ১০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
কথা হয় রাসেলের গ্রামের বাসিন্দা মনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রাসেলের বাবা মুন্সি মিয়া ভূমিহীন। অভাবের কারণে এক যুগেরও বেশি আগে পরিবার নিয়ে গাজীপুরে চলে যান তিনি। সেখানে শ্রমিকের কাজ করে সংসার চালাচ্ছিলেন। বাবা-মায়ের একমাত্র অবলম্বন ছিল রাসেল। তার মৃত্যুতে পরিবারটি মহাবিপদে পড়ে গেলো।’
এইচ এম কামাল/এসআর/জিকেএস