এসিল্যান্ড-সাঁওতাল হত্যা
খুনিকেই এমপি বানিয়েছে আওয়ামী লীগ!
সাঁওতালদের জমি দখল করে রিসোর্ট করতে যান তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ। এতে বাধা হয়ে দাঁড়ান সহকারী কমিশনার (ভূমি) অবিদীয় মার্ডি’। তাকে খুন করে নিজের পথের কাঁটা সাফ করে এগিয়ে যান কালাম। পরে সক্রিয় হন সাঁওতালরা । গড়ে তোলেন আন্দোলন। সাঁওতাল আন্দোলন দমাতে তিন সাঁওতালকেও হত্যা করা হয়। তারপরও জমি চাই তার। এমন খুনিকেই চলতি বছর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক দিয়ে এমপি করেছে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হওয়ার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন আজাদ। ভূমি দখল, সাধারণ মানুষকে নির্যাতন, হত্যা, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসার অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তোলেন পুরো গোবিন্দগঞ্জ। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, সংখ্যালঘু, আওয়ামী লীগ, বিএনপি-জামায়াত কেউই রক্ষা পায়নি তার হাত থেকে। টাকা কামানোর নেশায় তিনি যা ইচ্ছে তাই করতেন। এতে প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে বাধ্য করা হতো। তার কাজে সম্মত না হলে অফিসারদের সহকারী কমিশনার (ভূমি) অবিদীয় মার্ডির পরিণতির কথা মনে করিয়ে দেওয়া হতো।
- আরও পড়ুন
- সাবেক এমপি, এএসপিসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা
- আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ চেয়ে করা রিট খারিজ
৫ আগস্ট পদত্যাগ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ ঘুরে আবুল কালাম আজাদের এমন অপকর্মের ফিরিস্তি উঠে এসেছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ ভূমি দখল, সাধারণ মানুষকে নির্যাতন, হত্যা, চাঁদাবাজি মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে ছিল উপজেলাজুড়ে। গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার হাসিনা দেশ থেকে পালানোর পর তিনিও নেতাকর্মীসহ অপরাধমূলক কাজের সহযোগীদের ছেড়ে পালিয়েছেন। নেতাকর্মীরা মামলা হামলার ভয়ে পালিয়ে থাকলেও সবচেয়ে ভয়ে আছে তার অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকা ব্যক্তিরা।
এমপি আজাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে তার আত্মীয়স্বজনসহ অনেকেই কোটি কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। যারা তার সাথে থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন অনেকেই আবার সুর পাল্টে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে থাকা আত্মীয়স্বজনদের দারস্থ হয়েছেন। এরই মধ্য অনেকেই বিএনপি-জামায়াত নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন তাদের দলে যোগ দেওয়ার জন্য।
- আরও পড়ুন
- অন্য দলের নেতাকর্মীদের জন্য বিএনপির দরজা আপাতত বন্ধ
- জামায়াতে যোগ দিতে ঊর্ধ্বতন নেতাদের অনুমতি লাগবে
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, গোবিন্দগঞ্জ আসনটি উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত। জেলাটি বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে খ্যাত। রংপুর অঞ্চলের দূরপাল্লার বাস থেকে শুরু করে সব ধরনের যানবাহন উপজেলার ওপর দিয়ে যাতায়াত করে। এসব যানবাহন থেকে প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। শহরের কেউ বাসা-বাড়ি নির্মাণ করলে মালিককে মোটা অংকের টাকা দিতে হতো। অন্যের জমি দখল করে নিজের দাবি করলেও কেউ কোনো টুঁ শব্দ করার সাহস পেতেন না। মাদক ব্যবসা ছিল পুরোটাই তার নিয়ন্ত্রণে। পুলিশ প্রশাসন তার বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। কেউ কোনো প্রতিবাদ করলেই গুন্ডাবাহিনী দিয়ে লাঞ্ছিত করা হতো। পরে তার ভাড়া করা বাহিনী দিয়ে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মানববন্ধন করতেন। তার মনোনীত কয়েকজন সাংবাদিক মাসোহারা নিয়ে শুধু উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরতেন। বিনা অপরাধে বহু মানুষকে নির্যাতন ও হত্যাও করা হয়েছে। পুলিশ বাহিনী ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। কেউ অভিযোগ দিতে গেলে পাল্টা ভয়ভীতি দেখানো হতো। ভোটের মাঠে মোটা অংকের টাকা ছড়িয়ে প্রশাসন থেকে শুরু করে অনেক সুশীল সমাজ তিনি ম্যানেজ করতেন।
তার নিজের শ্যালক মুকিতুর রহমান রাফিকে নৌকার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে তার পালিত বাহিনী দিয়ে ভোটকেন্দ্র দখল করে মেয়র বানিয়েছেন। সম্প্রতি উপজেলা নির্বাচনে তার মনোনীত প্রার্থী বুলবুল আলম শাকিল আকন্দকে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানও বানিয়েছেন। উপজেলায় তার পাঁচ শতাধিক সদস্য নিয়ে একটি বাহিনীও গঠন করে ছিলেন। তাদের দিয়ে সব ধরনের অপরাধমূলক কাজ করাতেন তিনি।
মাদক ব্যবসা, ট্রাক-দূরপাল্লার বাসসহ বিভিন্ন যানবাহন, ভূমি দখল, হাটবাজার সরকারি অফিস থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০ লাখ টাকা আদায় করতেন। এর মধ্য থেকে তার বাহিনীদের পেছনে প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচ করতেন। যারা আজাদের অতি আপন হতে পেরে ছিলেন, তাদের ভাগ্য বদলে স্বপ্ন দেখতে হয়নি। তারা বাস্তবেই কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাদের নামে লিজ হতো সরকারি জমি, হাটবাজার, খেয়াঘাট, উপজেলার প্রকল্পের বরাদ্দ, জলমহালসহ ঠিকাদারি কাজ। উপজেলার অন্য জনপ্রতিনিধি তার অধরাধমূলক কাজে বাধা দিলে জামায়াত-বিএনপি তকমা লাগিয়ে মামলা দিয়ে হয়রানি করতেন ও কোণঠাসা করে রাখতেন। এর সব কিছুর হিসাব নিতেন তার ব্যক্তিগত সহকারী আতিকুর রহমান আতিক। ভারতীয় চোরাচালানের ব্যবসা ঢাকায় বসে নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি শ্রীকৃষ্ণ চাকী।
আবুল কালাম আজাদ এক সময় জাসদ ও বাসদ ছাত্রলীগ করতেন। ১৯৮৬ সালে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মইনুল হাসান রুবেল হত্যা মামলায় কারাগারে যান তিনি। মামলাটি এখন হাইকোর্টে। ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে এমপি হওয়ার পর তিনি মিথ্যা মামলা দিয়ে সাংবাদিক ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদেরও হয়রানি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া প্রায় ২২ কোটি টাকার চাল আত্মসাতের ঘটনায় দুদকের তদন্তে তার নাম আসে।
এসিল্যান্ড অবিদীয় মর্ডি হত্যার মূল নায়ক এমপি আজাদ
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান থাকায় উপজেলার সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম এলাকায় রিসোর্ট তৈরির জন্য নিরীহ সাঁওতালদের প্রলোভন দিয়ে তাদের জমি ক্রয়ের নামে দখল শুরু করেন। ২০ শতক জমি কিনে পাঁচ থেকে ১০ বিঘা পর্যন্ত সাঁওতালদের কাছ থেকে দলিল করে নেন। বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন দায়িত্বরত উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) অবিদীয় মার্ডির সন্দেহ হয়। তিনি সরেজমিনে সাহেবগঞ্জে সাঁওতালদের কাছে জানতে চান। পরে ওই এলাকার জমি বিক্রেতা সাঁওতালদের হিসাব অনুযায়ী সম্পদের দলিলে জমির পরিমাণ আকাশ-পাতাল পার্থক্য হয়। বিষয়টি নিয়ে এসিল্যাল্ড প্রতিবাদ করলে আবুল কালাম আজাদ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। পথের কাঁটা সরাতে ২০১৪ সালের ১১ জানুয়ারি উপজেলার সাপমারা ইউনিয়নে কাটামোড় এলাকায় একটি লাইন্সেসবিহীন গাড়ি দিয়ে ধাক্কা দেন তাকে। তার মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য শরীরের বিভিন্ন স্থানে যখম করা হয়। পরে ময়নাতদন্ত ছাড়াই তার লোকজন দিয়ে এসিল্যান্ডের গ্রামের বাড়ি নওগাঁর ধামিরহাট শিবরামপুরে দাফন করেন। এসিল্যান্ড অবিদীয় মার্ডির স্ত্রী শেফালী পুলিশ প্রশাসন ও আদালত চত্বর ঘুরেও কোথাও স্বামীর হত্যার বিচার পাননি। হতাশ হয়ে তিনি তার স্বামী হত্যার বিচারের আশা ছেড়ে দেন। অবিদীয় মার্ডির বড় বোন ইমেলডা মার্ডি হাল ছাড়েননি। এখনও ছোট ভাই হত্যার বিচারের দাবিতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তিনি।
ইমেলডা মার্ডি জাগো নিউজকে বলেন, আমার ছোট ভাই এসিল্যান্ড অবিদীয় মার্ডি আবুল কালাম আজাদের অন্যায় কাজের প্রশ্রয় দেননি। তার অপকর্মের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ানোর কারণের হত্যা করে দুর্ঘটনার নাটক সাজিয়েছেন। গত ১৬ বছরের অনেক হত্যার বিচার হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার বলেছে, সব হত্যার বিচার হবে। আমার ভাইয়ের হত্যাকারীদের বিচার হলে আমার আর এই পৃথিবীতে কিছু পাওয়ার নেই।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে অনেকে বলেছে কালাম ভাই অনেক প্রভাবশালী। তার বিরুদ্ধে লাগতে যাইয়েন না। ভাইয়ের জন্য দোয়া করতে পারেন। বিচারের আশা ছেড়ে দেন।’
এ কথা বলে হু হু করে কেঁদে কেঁদে ইমেলডা মার্ডি বলেন, ‘একজন খুনি কীভাবে এমপি হয়।’
তিন সাঁওতাল খুনেরও আসামি কালাম
জমি দখলের জন্য ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর উচ্ছেদের নামে সাঁওতালদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুট ও তিন সাঁওতালকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় (মামলা নং ৫৬০/২০১৮) প্রধান আসামি সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদ। দীর্ঘদিন থেকে মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য সাঁওতালদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করছেন। বাঙালি-আদিবাসী নামে তার লোকজন দিয়ে কমিটি তৈরি করেও ব্যর্থ হন। পুলিশ প্রশাসন দিয়ে নিয়মিত ভয়ভীতি প্রদর্শন করে আসছিলেন।
গোবিন্দগঞ্জ সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম ভূমি পুনরুদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি আদিবাসী নেতা ডা. ফিলিমন বাস্কে বলেন, ‘আবুল কালাম আজাদ এসিল্যান্ড অবিদীয় মার্ডি ও তিন সাঁওতাল হত্যা মামলার আসামি। এসব মামলা এখনও চলমান। তাকে কীভাবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে এবং এমপি হয়েছেন, তা আমাদের বোধগম্য নয়।’
তিনি বলেন, ‘আবুল কালাম পালিয়ে আছেন। তার লোকজন প্রতিনিয়ত হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন। এই ভূমিদস্যু সন্ত্রাসীর আমরা বিচার চাই।’
ছাত্রনেতা রুবেল হত্যাসহ অসংখ্য অপকর্মের হোতা কালাম
উপজেলা ছাত্র ইউনিয়নের নেতা রুবেল হত্যার প্রধান আসামিও আবুল কালাম আজাদ। অসংখ্য সাধারণ মানুষকে নির্যাতন, বাড়ি ছাড়া ও হত্যা, সাংবাদিক নির্যাতন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিটি বাণিজ্য, উপজেলা শহরের সরকারি জমি দখল করে মার্কেট নির্মাণ করে দোকানঘর বিক্রি করা। প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগবিরোধী লোকজনকে তার বাহিনী দিয়ে তুলে নিয়ে অত্যাচার নির্যাতন করতেন। বিএনপি-জামায়াতের দলীয় অফিস ভাঙচুর করে দখল করতেন। উপজেলার যেসব অফিসার তার কথামতো চলতেন না তাদের হয়রানিসহ বদলি করাতেন। অন্যের জমি দখল করে চাঁদা দাবি করা। ভূমি অফিসগুলো থেকে মাসিক চাঁদা তোলা। সাব-রেজিস্ট্রার/দলিল লেখক সমিতিতে তার মনোনীত লোককে কমিটির দায়িত্ব দেওয়া। ভারত থেকে পণ্য নিয়ে এসে নিজের ভাইকে দিয়ে অবৈধভাবে ব্যবসা করা। এছাড়া নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
- আরও পড়ুন
- হাছান মাহমুদের ভাইয়ের দখলে থাকা ২০০ একর বনের জমি উদ্ধার
- পলক ৬, টুকু-জয়-আহমদ-সোহায়েল-সৈকত তিনদিনের রিমান্ডে
২০১৮ সালে ১৭ মে যুগান্তরে প্রিন্ট ভার্সনে প্রকাশিত গাইবান্ধায় ৬৫ মাদক স্পর্ট, ১২১ জনের শিরোনামে প্রকাশিত রিপোর্টটিতে মাদককারবারি হিসেবে এমপি আবুল কালাম আজাদের নাম ছিল অন্যতম।
বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়, ঢাকা শহরসহ বিভিন্ন স্থানে পঞ্চাশটি বাড়ি আছে তার। গাইবান্ধা থেকে গোবিন্দগঞ্জ স্পেশাল নামে যেসব গাড়ি চলে তার মালিক তিনি। তিনি বাবার জমি ভাগে পাঁচ বিঘা পেলেও বর্তমানে তার জমি হাজার বিঘার উপরে। এছাড়া উপজেলার প্রায় পঞ্চাশ বিঘার মতো সরকারি জলমহাল জবরদখল করে মাছের চাষবাদও করছেন তিনি। আবুল কালাম আজাদ পালিয়ে থাকার কারণে তার মন্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এসইউজে/এসএইচএস/জিকেএস