চিকিৎসক সংকটে চিকিৎসা ব্যাহত কালকিনি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে
আয়মনি বেগম। বয়স ৮০ বছর। চোখে ছানি পড়েছে। অপারেশন করাতে হবে, তাই মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার খাশেরহাট থেকে এসেছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। কিন্তু হাসপাতালে এসে শোনেন এখানে চোখের কোনো ডাক্তার নেই। এতে হতাশ হয়ে পড়েছেন এই বৃদ্ধা। কারণ তার ভ্যানচালক ছেলের পক্ষে ব্যক্তিগতভাবে ডাক্তার দেখানো সম্ভব না।
শুধু আয়মনিই নয়, উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেককেই চোখের চিকিৎসার জন্য কালকিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসে ডাক্তার না থাকায় ফিরে যেতে হয়।
শুধু ডাক্তার সংকট নয়, হাসপাতালে রয়েছে নানা সমস্যা। দিনের পর দিন এক্স-রে মেশিন নষ্টসহ নানা সমস্যার মধ্য দিয়েই চলছে চিকিৎসা সেবা। হাসপাতালের টয়লেটগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। নোংরা ও দুর্গন্ধের মধ্যেই রোগীদের যেতে হচ্ছে টয়লেটে।
সরেজমিনে রোগীদের সঙ্গে কথা বলে ও সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলা ১০টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। ৫০ শয্যাবিশিষ্ট কালকিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে উপজেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোগীরা চিকিৎসা সেবা নিতে আসেন। কিন্তু ডাক্তার সংকটসহ নানা সমস্যার জন্য তারা ঠিকমতো চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন না। ফলে অনেকেই প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দিকে ঝুঁকছেন। তবে সমস্যায় বেশি পড়তে হচ্ছে গরিব ও অসহায় রোগীদের। তারা টাকার অভাবে প্রাইভেট হাসপাতালে যেতেও পারছেন না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কালকিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ১৯৭৬ সালে মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার ঝাউতলা ও পাঙ্গাশিয়া মৌজায় নির্মিত হয়। প্রথমে ৩১ শয্যা নিয়ে হাসপাতালটি শুরু হয়। পরবর্তীতে ২০১০ সালে ৫০ শয্যায় উন্নিত করা হয়। তবে ৫০ শয্যায় উন্নতি হলেও ৩১ শয্যার লোকবল দিয়েই চলছে হাসপাতালটি।
এখানে মঞ্জুরীকৃত চিকিৎসকের ২৩টি পদ থাকলেও খালি আছে ১১টি পদ। খালি পদগুলোর মধ্যে রয়েছে জুনিয়র কনসালটেন্ট (অ্যানেসথেশিয়া), জুনিয়র কনসালটেন্ট (অর্থোপেডিক্স), জুনিয়র কনসালটেন্ট (কার্ডিওলোজি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (চক্ষু) প্রমুখ। এছাড়াও সিনিয়র স্টাফ নার্সের ৫টি পদ, চালকসহ আরও ৩৮টি পদ শূন্য রয়েছে।
এদিকে হাসপাতালে ৩টি এনালগ এক্স-রে মেশিন থাকলেও বর্তমানে সচল আছে মাত্র একটি। তবে সেটিও বেশিরভাগ সময় অকেজো হয়ে পড়ে থাকে। তাই রোগীদের প্রায় সময় বাহির থেকে টাকা দিয়ে এক্স-রে করাতে হচ্ছে। আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন আছে ৩টি। এরমধ্যে ২টি অনেকদিন ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।
হাসপাতালে জরুরি বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য একটি জেনারেটর মেশিন থাকলেও তা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। হাসপাতালে একটি গভীর নলকূপ থাকলেও বেশিরভাগ সময় তা নষ্ট থাকে। এছাড়াও বেশিরভাগ সময়ই হাসপাতালের মেঝেতে ময়লা-আবর্জনা ও নোংরা পরিবেশ দেখা যায়।
জানা যায়, প্রায় এক বছর আগে ২ কোটি ৫২ হাজার টাকা ব্যয়ে হাসপাতালের প্রথম ও দ্বিতীয় তলার ছাদ ভেঙে নতুন করে কাজ করানো হয়। পাশাপাশি নতুনভাবে বাথরুম, টয়লেট, দরজা-জানালা, টাইলস, ইলেক্ট্রনিকসহ প্রায় সব ধরনের কাজ করা হয়। অথচ মাত্র এক বছরেই বাথরুম, টয়লেটগুলোর অবস্থা করুণ। নোংরা ও দুগর্ন্ধে ভেতরে প্রবেশ করাই মুশকিল। তবুও বাধ্য হয়ে রোগীদের সেখানেই যেতে হচ্ছে।
এদিকে শয্যা সংকটের কারণে একই কক্ষে শুধুমাত্র বেড আলাদা করে ডায়রিয়া, ডেঙ্গু, প্রতিবন্ধী, মুক্তিযোদ্ধা রোগীদের রাখা হয়। এতে করে রোগীদেরও পড়তে হচ্ছে সমস্যায়।
হাতে সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন কালকিনি উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নের উত্তর কোচুরী সস্তাল এলাকার সাগর মোল্লা। তিনি বলেন, আমার হাতের এক্স-রে করানোর দরকার হয়। কিন্তু হাসপাতাল থেকে এক্স-রে করাতে পারিনি। টাকা দিয়ে প্রাইভেটভাবে করেছি। যদি হাসপাতালের এক্স-রে মেশিনগুলো ভালো থাকতো তাহলে ভালো হতো। বিশেষ করে গরিব রোগীদের বেশি উপকার হতো।
গত চারদিন ধরে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন কালকিনি উপজেলার এনায়েতনগর ইউনিয়নের করিমগঞ্জ এলাকার মো. ইব্রাহিম। তিনি বলেন, এই হাসপাতালে টয়লেটগুলোর যে অবস্থা, তাতে আমার ডায়রিয়া ভালো হবে কীভাবে তা নিয়ে শংকায় আছি। টয়লেটগুলো যেমন অপরিষ্কার, তেমনি দুর্গন্ধ। তাছাড়া একই কক্ষে ডায়রিয়া, ডেঙ্গুসহ সাধারণ রোগীরাও থাকছে। এটা কীভাবে সম্ভব। ডায়রিয়া ও ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা থাকার কথা।
হাসপাতালের প্রধান সহকারী নাহিদা আক্তার বলেন, ৩১ শয্যা হাসপাতালের লোকবল নিয়েই ৫০ শয্যার কাজ চালাতে হয়। ডাক্তার সংকটের পাশাপাশি জনবল ও নানা প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কম আছে। এরইমধ্যে একটি ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন, সেল কাউন্টার মেশিন, হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য ৩ জন ক্লিনারসহ আরও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য বরাবর দরখাস্ত দেওয়া হয়েছে। আশা করছি এগুলোর দ্রুত সমাধান হবে।
কালকিনি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এসকেএম শিবলী রহমান বলেন, হাসপাতালে জনবল সংকট। সংকটের মধ্য দিয়েই আমরা সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। সুইপার না থাকায় হাসপাতালের বাথরুম ও টয়লেট পরিষ্কার রাখা ঠিকমতো সম্ভব না। তবুও আমরা চেষ্টা করছি, যাতে রোগীদের সমস্যায় পড়তে না হয়। তাছাড়া হাসপাতালে জনবল সংকটের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জানানো আছে। আমরা এ ব্যাপারে স্থানীয় সংসদ সদস্যকেও জানিয়েছি। আশা করছি দ্রুত এর সমাধান হবে।
এফএ/জিকেএস