শতবর্ষী নৌকার গ্রামের কারিগরদের দুর্দিন
কাক ডাকা ভোরে শুরু হয় তাদের দিন। পেরেক ঠোকার খটখট শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে কর্মব্যস্ততা। কেউবা মাটিতে বিছাচ্ছেন তলা, কেউবা চেরাই করছেন কাঠ। এটি শরীয়তপুরের নৌকা তৈরির গ্রামের নিত্যদিনের চিত্র। যেখানে একশ বছর ধরে নৌকা গড়ানোর কাজ করে আসছেন অন্তত ৫০ কারিগর। তবে দিন দিন চাহিদা কমে আসায় অনেকেই ছেড়েছেন বাপ-দাদার এ পেশা। গুটিকয়েক যারা আছেন, তারা চেয়েছেন সরকারি সহযোগিতা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিচু অঞ্চলের জনপদ হওয়ার আদিকাল থেকে শরীয়তপুর জুড়ে নৌকার চাহিদা ছিল ব্যাপক। বর্ষা মৌসুমে এ অঞ্চলে পণ্য পরিবহনে নৌকার প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায় বহু গুণ। আর এই প্রয়োজনীয়তা থেকে অন্তত ১০০ বছর আগে সদর উপজেলার রুদ্রকর ইউনিয়নের চন্দনকর এলাকায় নৌকা তৈরির কাজ শুরু হয়। এলাকার ৫০টি পরিবারের অন্তত দেড়শ কারিগর নৌকা তৈরির কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
এখানকার তৈরি নৌকার স্থানীয় হাটবাজারে খুব চাহিদা। পাশের জেলা চাঁদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জসহ ১০ জেলার ক্রেতারা হাটে আসতেন, আর পছন্দ করে কিনে নিয়ে যেতেন নৌকা। তবে দিন দিন বর্ষা মৌসুমে পানি কম হওয়া ও নৌকা তৈরির কাঠের যোগান না মেলায় অনেকে ছেড়েছেন এই পেশা। আর সেই সঙ্গে পাতাম আর পেরেকের দাম বৃদ্ধি তো আছেই। বর্তমানে হাতেগোনা ১৫টি পরিবার এ কাজে থাকলেও, আগ্রহ হারাচ্ছেন নতুন প্রজন্মরা।
সম্প্রতি সরেজমিনে চন্দনকর এলাকায় দেখা যায়, ঘরের বারান্দার সঙ্গে টিন দিয়ে বানানো হয়েছে অস্থায়ী ছাউনি। সেখানে কাঠের পাটাতনের ওপর কাঠ জোড়া দিয়ে পেরেক ও পাতামের সাহায্যে গড়া হচ্ছে নৌকা। কেউ কেউ কাঠ কেটে ও ছেঁচে জোড়া দিচ্ছেন। আবার কেউবা নৌকা তৈরিতে সাহায্য করছেন। নৌকা তৈরি শেষে উন্মুক্ত উঠোনে জড়ো করে রাখা হয়েছে বিক্রির উদ্দেশ্যে।
চন্দনকর এলাকার নৌকার প্রবীণ কারিগর শুনীল মণ্ডল। দুই ছেলে সুমন ও সুব্রতকে সঙ্গে নিয়ে নৌকা গড়ানোর কাজ করছেন। একসময় তার বাবা সূর্য কুমার তৈরি করতেন নৌকা। মূলত বাবার কাছ থেকে নৌকা তৈরির শিল্পটি রপ্ত করেছিলেন শুনীল। বাবা মারা যাওয়ার পর বংশ পরম্পরায় কাজটি ধরে রেখেছেন তিনি।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, এক সময় আমার দাদা নৌকা বানাতেন। দাদার পর আমার বাবা বানিয়েছেন। এখন আমি ও আমার দুই ছেলে নৌকা বানাই। এটি আমাদের পূর্ব পুরুষের পেশা। তবে এখন পানি কম হওয়ায় নৌকার চাহিদা কম। আমাদের তেমন লাভ হচ্ছে না।
নৌকার কারিগর সুব্রত মণ্ডল বলেন, ১০ বছর আগেও আমাদের সারা মাস নৌকা তৈরির কাজ থাকতো। চাহিদা থাকায় আগাম বছরের জন্য নৌকা বানিয়ে রাখতাম। এখন শুধু তিন মাস নৌকা গড়াই, বাকি মাস অন্যান্য কাজের ওপর নির্ভর করতে হয়। তবে সরকার যদি আমাদের প্রণোদনা দিতো এবং পানিসমৃদ্ধ হাওড়াঞ্চলে নৌকাগুলো বিক্রির সুযোগ করে দিতো তাহলে শিল্পটি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো।
শুনীল মণ্ডলের পরিবারের মতো একই এলাকায় নৌকা গড়ার কাজ করছেন বিনয় তপাদার ও তার কলেজ পড়ুয়া ছেলে প্রদীপ তপাদার। তবে দিন দিন চাহিদা কমে যাওয়ায় তারাও পেশাটিকে ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন।
বিনয় তপাদার বলেন, একসময় এই এলাকায় আমাদের মতো ৫০টি পরিবার নৌকা বানাতো। আমাদের তৈরি নৌকা গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, চাঁদপুরসহ অন্তত ১০টি জেলায় বিক্রি হতো। লোকজন শরীয়তপুরে এসে পছন্দ মতো নৌকা কিনে নিয়ে যেতো। তবে সেই দিন আর নেই। এখন নৌকার চাহিদা কম থাকায় আমরা ১০-১৫টি পরিবার নৌকা বানাই।
প্রদীপ তপাদার বলেন, আমি পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার সঙ্গে নৌকা বানাই। এটি আমাদের পূর্ব পুরুষের পেশা। তবে এখন নৌকা তৈরির কাঠের যোগান পাওয়া কষ্টকর। এছাড়া পাতাম আর পেরেকের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন তেমন লাভ হয় না। তাই অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। আমরাও হয়তো আর এই কাজ বেশিদিন করবো না।
জানতে চাইলে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাইনউদ্দিন বলেন, গ্রামটি ঐতিহ্যবাহী নৌকা গ্রাম হিসেবে পরিচিত। এটি যেহেতু কালের বিবর্তনে পিছিয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে, তাই আমরা খোঁজ নিয়ে এ পেশার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের সরকারি সহযোগিতা করা হবে। পাশাপাশি শিল্পটি ধরে রাখতে তারা যে অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে নৌকাগুলো বিক্রি করতে চান, সে অঞ্চলের প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করবো।
বিধান মজুমদার অনি/জেডএইচ/জিকেএস