হাওরে ‘আফাল’র তাণ্ডবে নিঃস্ব মানুষ
বিশাল জলরাশির ওপর থালার মতো ভাসছে একেকটা গ্রাম। দূর থেকে মনে হয় ছোট ছোট দ্বীপ। হাওরের উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে গ্রামের আঙিনায়। দমকা বাতাসের সঙ্গে হাওরে ওঠা বড় বড় ঢেউকে স্থানীয় ভাষায় ‘আফাল’ বলা হয়। নেত্রকোনার হাওরে এই আফালের তাণ্ডবে ভাঙছে বসতভিটা, ঘরবাড়ি ও পথঘাট। এসব আফালের কাছে অসহায় মানুষ।
এরইমধ্যে ঢেউয়ের তাণ্ডবে বিলীন হয়েছে অন্তত ১৬টি গ্রাম। এবছরও ভাঙছে খালিয়াজুরী সাতগাঁও থেকে বোয়ালী সড়কসহ গাজীপুর ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রামের বাড়িঘর। তবে এ অঞ্চলে নদী খননসহ গ্রামগুলোর প্রতিরক্ষা দেওয়াল নির্মাণের আশ্বাস দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য।
জেলার খালিয়াজুরী উপজেলায় হাওর ও ধনু নদীর ঢেউয়ের তাণ্ডবে অনেক গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনের কবলে পড়ে এরইমধ্যে সর্বস্বান্ত হয়েছেন হতদরিদ্র সহস্রাধিক পরিবার। সব হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন গ্রামে। হাওরে বাতাস যত বাড়ে আফালের তাণ্ডব তত ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। তিন থেকে চার ফুট উঁচু ঢেউ আছড়ে পড়ে হাওড় পাড়ের গ্রামগুলোতে। এর ফলে গ্রামে গ্রামে ভাঙন দেখা দেয়। বিলীন হয় পথঘাট, ঘরবাড়ি।
স্থানীয় সূত্র জানায় গত কয়েক বছরে অনেকগুলো গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে। এগুলো হলো- জগদীশপুর, মাগনপুর, বিক্রমপুর, কানাইনগর, সুলতানপুর, আমীনপুর, খুরশীগঞ্জ, কালিপুর, হ্যামনগর, আছানপুর, নূরপুর, কাছারীবাড়ী, হাবিবপুর, দুর্গাবাড়ী, নগর, শিবপুর, কামারবাড়ী, নরসিংহপুর, নয়ানগর ও সঁওতাল গ্রাম। ভূমি মানচিত্রে ও ভূমি রেকর্ডে এ গ্রামগুলো উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে এগুলো নেই। এছাড়া নদী ও হাওরের বুক চিরে দিনরাত বড় বড় কার্গো, লঞ্চ ও ট্রলার চলাচলের সময় সৃষ্ট ঢেউ গ্রামগুলোতে আঘাত হানে। এতেও গ্রামে ভাঙন দেখা দেয়। শুধু গ্রাম নয়, ঢেউয়ের থাবা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না হাট-বাজারও। উপজেলা সদরের বেশ কয়েকটি সরকারি ভবন যেকোনো সময় বিলীন হয়ে যেতে পারে।
খালিয়াজুরী উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, এরইমধ্যে এসব আশ্রয়হারা মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহারের জমিসহ ঘর দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৫৬৩টি পরিবারকে। এরমধ্যে খালিয়াজুরীতে ৬৩৪টি, মেন্দীপুরে ৪১টি, চাকুয়ায় ৬৩টি, নগরে ১৬৪টি, কৃষ্ণপুর ১৯১টি ও গাজীপুর ইউনিয়নে ৩৭৪টি পরিবারকে দেওয়া হয়েছে জমিসহ ঘর।
খালিয়াজুরীর জাহেরপুর গ্রামের আবু বকর ও জাহিদ মিয়া বলেন, আমাদের বাড়িঘর সব ভেঙে গেছে। এখন সরকারি ঘরে (আশ্রয়ন প্রকল্পে) থাকি। হাওরে ঢেউ শুরু হলে রাতে সন্তানদের নিয়ে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না। আতঙ্কে থাকি কখন কী হয়।
তারা আরও বলেন, হাওরাঞ্চলে পানিসহিষ্ণু হিজল, করচ ও চাইল্যা বন আশঙ্কাজনকহারে কমে গেছে। এ কারণে প্রতি বছরই আফালের তাণ্ডবে বাড়িঘর ভেঙে যাচ্ছে।
খালিয়াজুরী হেমনগরকান্দা আশ্রয়ন প্রকল্পের বাসিন্দা হরজুল মিয়া, বিদুর দাস ও গেজন্ড দাস বলেন, নিজেদের জমি বাড়ি ছিল। ধনু নদীর ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে এখন আশ্রয়ন প্রকল্পে বসবাস করি। এটা হাওরের মাঝখানে। হাওড়ে বিলের ইজারাদাররা নামতে দেয় না। আমাদের সংসার চালানোই এখন দায়।
একই উপজেলার মজিবনগর আশ্রয়ন প্রকল্পে বসবাসকারী সোবান মিয়া, সোনা মিয়া ও মমতাজ বেগম বলেন, হাওরের ভেতরে কোনো কামকাজ নাই। খালি পানি আর পানি। এই পানি আর ঢেউয়ে সব ভাসায়ে নিছে। এখন পথের ভিখারীর মতো বেঁচে আছি। আমাদের আশ্রয়ন প্রকল্পের চারদিকে ওয়াল না দিলে এই বাড়িঘরও ভাসাইয়া নিয়ে যাইবো।
নেত্রকোনা কৃষক সমিতির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার আনিছুর রহমান বলেন, হাওরবাসীর দুঃখ কেউ বুঝতে চান না। নির্বাচন এলে জনপ্রতিনিধিরা আফালের তাণ্ডব থেকে বাড়িঘর রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিলেও নির্বাচিত হওয়ার পর তারা আর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেন না।
নেত্রকোনা-৪ (মদন-মোহনগঞ্জ-খালিয়াজুরী) আসনের সংসদ সদস্য সাজ্জাদুল হাসান বলেন, ‘আমরা সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে বিষয়টি জানাবো। এছাড়াও এনজিওসহ যারা হাওরাঞ্চল নিয়ে কাজ করেন তাদের জানাবো। ঢেউয়ে যাতে বাড়িঘর রাস্তাঘাটের ক্ষতি না হয় সেই পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
এইচ এম কামাল/এফএ/জেআইএম