অবহেলায় মৃতপ্রায় ফরিদপুরের কোহিনুর লাইব্রেরি
বছরের পর বছর অযত্ন-অবহেলায় থাকা ফরিদপুর শহরের টেপাখোলায় অবস্থিত কোহিনুর পাবলিক লাইব্রেরি আজ মৃতপ্রায়। প্রায় ৯২ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরিটির বর্তমান অবস্থা খুবই করুন। অযত্নে নষ্ট হচ্ছে বইসহ লাইব্রেরির আসবাবপত্র। কয়েক বছর ধরে রয়েছে তালাবদ্ধ। ফলে পাঠকদের নেই কোনো আনাগোনা। এখনকার প্রজন্ম কোহিনুর লাইব্রেরিটি সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। কেবল কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী লাইব্রেরিটি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৩২ সালে ১০ শতাংশ জমির ওপর লাইব্রেরিটি প্রতিষ্ঠা করেন শহরের হাবিলি গোপালপুর এলাকার বাসিন্দা প্রয়াত মজিদ মিয়া। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে ঘরে ঘরে গিয়ে বই সংগ্রহ করেছেন মজিদ মিয়া। তবে তার এ উদ্যোগের সঙ্গে আরও কয়েকজন বইপ্রেমি মানুষ যুক্ত ছিলেন। এক সময় ১০ হাজারের অধিক বই ছিল লাইব্রেরিটিতে। বইপ্রেমিদের ছিল উপচেপড়া ভিড়। লাইব্রেরিটিতে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো মানুষের পদচারণা ছিল। দশ হাজারের অধিক বই থেকে কমতে কমতে এখন সর্বোচ্চ ৪ হাজারের মতো বই থাকলেও তাও নষ্ট হওয়ার উপক্রম।
সরেজমিনে দেখা যায়, ফরিদপুর শহরের টেপাখোলা থেকে হরিসভা যাওয়ার রোডের ঠিক মোড় এলাকায় হৃদয় রবিদাসের দোকানের পাশ ঘেঁসে একটা গলি। গলিতে ময়লা আবর্জনার স্তূপ। গলির শেষের দিকে একটি গেট। গেটে রয়েছে কোহিনুর পাবলিক লাইব্রেরির একটি সাইনবোর্ড। দোতলা ভবনের মূল গেটটির দরজা তালাবদ্ধ। লাইব্রেরিতে প্রবেশের দরজাটিও তালাবদ্ধ। তবে পাঠাগার ঘিরে রয়েছে ২২ টির মতো দোকান।
স্থানীয়রা জানান, কয়েক বছর ধরে লাইব্রেরিটি তালাবদ্ধ। উপরের তলায় ১০ টির মতো কাঠের আলমারিতে এখনো কয়েক হাজার বই রয়েছে। তা অযত্ন আর অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে। লাইব্রেরির ব্যবস্থাপনা কমিটির উদাসীনতা ও অসহযোগিতায় এমন দৈন্যদশা। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জানে না ফরিদপুর শহরে কোহিনুর নামে একটি পাবলিক লাইব্রেরি আছে। পাঠাগারে তিন বছর মেয়াদের একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকার কথা। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর ধরে কোনো নির্বাচন নেই। হচ্ছে না নতুন কমিটি। পুরোনো কমিটির সম্পাদক গোলাম রাব্বানী ভূঁইয়া পদত্যাগ করেছেন। পাঠাগারের মূল ফটকটি সব সময় তালাবদ্ধ থাকে। পাঠাগারে একজন কর্মচারী থাকলে তিনিও নিয়মিত থাকেন না। সভাপতি ফারুক হোসেন। অন্য সদস্যদের তালিকা বা খোঁজ জানা যায়নি।
আগে এ পাঠাগারে ১০ হাজারের বেশি বই ছিল। এখন তা নেই। ১৫ বছরের কমিটির সদস্যরা পাবলিক লাইব্রেরির পরিচালনায় অনাগ্রহী। নতুন কমিটি গঠনেও নেই কারো কোনো উদ্যোগ। কেবলমাত্র লাভজনক হওয়ায় ২২ টি দোকান ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে অতি উৎসাহী। কমিটির লোকজন রুম প্রতি ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় মাসিক ভাড়া নিয়ে অন্যদের কাছে দেড় থেকে দুই হাজার টাকায় ভাড়া দিয়েছেন। এতে ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও লাভবান হচ্ছেন কমিটির সদস্যরা। দোকান ভাড়ার টাকাটা প্রতিষ্ঠানের ফান্ডে জমা হলেও লাইব্রেরিটি ভালোভাবে পরিচালনা করা সম্ভব।
লাইব্রেরিটির গ্রন্থাগারিক বদিউজ্জামান বলেন, লাইব্রেরিতে এখন আর আগের মতো লোকজন বা পাঠক আসেন না। বসে বসে অযথা সময় নষ্ট হয়। একারণে এখন আর নিয়মিত সময় দেওয়া হয় না।তবে মাঝেমধ্যে তিনি যান।
পাঠাগারটির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত মজিদ মিয়ার ছেলে মাহমুদুল হাসান বলেন, কোহিনুর পাবলিক লাইব্রেরিটি শুধু অব্যবস্থাপনা, অযত্ন আর অবহেলায় আজ ধ্বংসের পথে। অনেকবার সচলের উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়েছি।তবে চোখের সামনে এমন দৈন্যদশা দেখে খুবই খারাপ লাগে।
তিনি আরও বলেন, গত প্রায় ১৫ বছরের বেশি হতে চললো লাইব্রেরির পরিচালনা কমিটির কোনো সভা বা নির্বাচনও হয় না। প্রতিষ্ঠালগ্নে বাবা তার কিছু ছাত্রদের সাথে নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে লাইব্রেরিটির জন্য বই সংগ্রহ করতেন। এভাবে তিনি তিলে তিলে লাইব্রেরীটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু এখনকার প্রজন্ম কোহিনুর লাইব্রেরীটি সম্পর্কে কিছুই জানেনা। কেবল কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী পুরনো লাইব্রেরীটি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লাইব্রেরি মালিকানাধীন দোকানের ভাড়াটিয়া জানান, লাইব্রেরি পরিচালনা কমিটির সদস্যরা নামমাত্র মূল্যে দোকানগুলো বরাদ্দ নিয়ে তারা বেশি টাকায় ভাড়া দিয়েছেন। বরাদ্দপ্রাপ্তরা ভাড়াটিয়াদের কাছে দোকানভেদে এক থেকে দেড় লাখ টাকা অ্যাডভান্স নিয়ে এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকায় মাসিক ভাড়া দিয়েছেন।
ফরিদপুর প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল ইসলাম পিকুল বলেন, এই লাইব্রেরিটি ফরিদপুরের ঐতিহ্যবাহী একটি প্রতিষ্ঠান। এখন আর কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না। বছরের পর বছর অযত্ন-অবহেলায় কালের সাক্ষী হিসেবে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। সদিচ্ছা থাকলে এটি সুন্দরভাবে পরিচালনা করা সম্ভব। লাইব্রেরির দোকানগুলো থেকে যে আয় আসে তা দিয়েই চলতে পারে। লাইব্রেরির ব্যবস্থাপনা কমিটিকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানাই।
এ ব্যাপারে কহিনুর লাইব্রেরির সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানী ভূঁইয়া বলেন, জানামতে লাইব্রেরিতে প্রায় দশ হাজার বইয়ের মধ্যে এখনো প্রায় ৪ হাজারের অধিক বই আছে। বাকি বইগুলো কোথায় গেলো বলা সম্ভব নয়। এখনো লাইব্রেরিটি সুন্দরভাবে চালু বা পরিচালনা করা সম্ভব। বিশেষ করে ২২ টি দোকানের ভাড়ার টাকা বর্তমান বাজারমূল্যে সমন্বয় করে ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠানটি চালু রাখা সম্ভব।
এ বিষয়ে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) কামরুল আহসান তালুকদার বলেন, ফরিদপুরের ঐতিহ্যবাহী ও পুরাতন একটি প্রতিষ্ঠান কোহিনুর পাবলিক লাইব্রেরি। এরই মধ্যে ঐতিহ্যবাহী এ লাইব্রেরিটিকে চালু করতে ৫০ হাজার টাকা অনুদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিগগির উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে একটি প্রজেক্টের মাধ্যমে অনুদান দেওয়া হবে।
এন কে বি নয়ন/এমএএইচ/জেআইএম