গরুর হাটে বাছুর কেনা-বেচার মহোৎসব
- গো-খাদ্যের দাম বাড়ায় লাভ কমলেও থেমে নেই বাছুর বেচাকেনা
- জাত ও আকার ভেদে বাছুরের দাম ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ
কোরবানির ঈদের পরে পাবনার গরুর হাটগুলোতে এখন বাছুর কেনা-বেচার মহোৎসব চলছে। বছর ঘুরলে সেগুলো লাখ টাকার সম্পদে পরিণত হবে এ আশায় বাছুর কিনছেন খামারি ও ক্ষুদ্র চাষিরা। তবে খাদ্যের উচ্চমূল্যের কারণে লাভের সম্ভাবনা কম বলে জানিয়েছেন ক্রেতারা। তারপরও বাছুর কেনায় ভাটা পড়েনি। কারণ হিসেবে ক্ষুদ্র চাষিরা বলছেন, গো-খাদ্যের টাকা যাবে দিনে দিনে আর বছর শেষে একবারে টাকাটা হাতে আসবে, তাদের কাছে এটাই লাভ।
প্রাণিসম্পদ বিভাগ বলছে, জেলাজুড়ে ঈদ পরবর্তী এ মৌসুমে অন্তত অর্ধলাখ বাছুর কেনা-বেচা হবে। তাদের মতে, কাঁচা ঘাস ও মোলাসেস খাওয়ালে উৎপাদন খরচ কমবে। চাষিরা যদি তাদের পরামর্শ মোতাবেক বাছুর লালন-পালন করেন তাহলে সবাই লাভের মুখ দেখবেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খামারি ও ক্ষুদ্র চাষিরা তাদের পালন করা ষাঁড় সাধারণত কোরবানি ঈদের আগে বিক্রি করেন। দেশে ‘গোশত সমিতি’ (সমিতি করে টাকা তুলে গরু কেনা) বেড়ে যাওয়ায় রমজান মাস শেষেও প্রচুর ষাঁড় বিক্রি হয়। এসব খামারি বাছুর কিনে নতুন করে খামার সাজান। তারা সাধারণত কোরবানি ঈদের পরের হাটগুলোতে বাছুর কেনেন।
পাবনার বনগ্রাম গরুর হাটে ওঠা বাছুর-ছবি জাগো নিউজ
কেনার পরই বাছুরকে স্বাভাবিক ঘাস খাওয়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মোলাসেস খাওয়াতে পারলে অল্প খরচে বাছুরটি স্বাস্থ্যবান ষাঁড় বা গাভিতে পরিণত হয়। উচ্চমূল্যের খাদ্য এড়িয়ে কাঁচা ঘাসে খরচ কমে যায়। আর জেলাজুড়ে কাঁচা ঘাসের প্রাচুর্য রয়েছে। এতে বাছুর পালন করে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল।—প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. গৌরাঙ্গ কুমার তালুকদার
এ বিষয়টি একটি রেওয়াজে পরিণত হওয়ায় এ সময় গরু হাটে বাছুরের আমদানিও বেশি হয়। ঈদের পরে ওইসব খামারি বাছুর কিনে বছরব্যাপী লালন-পালন করেন। কিছু চাষি বা খামারি শীতের শেষেও বাছুর কেনেন। এর কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছেন, শীতে বাছুরের শারীরিক বৃদ্ধি কম হয়। এজন্য শীত শেষ হওয়ার পর অনেকে বাছুর কিনে মোটাতাজা করেন।
পাবনার অরণকোলা, কাশীনাথপুর, করমজা চতুরহাট, আরিফপুর হাজিরহাট, পুষ্প পাড়া ও বনগ্রাম গরুর হাটে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রতি বছরের মতো এবারও প্রচুর বাছুর কেনা-বেচা চলছে। বাছুরের আকার ও জাত ভেদে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিছু কিছু বাছুর দেখতে বড় গরুর মতো। উন্নত জাতের হওয়ায় সেগুলো দেখতে বড়। যেমন: শাহীওয়াল জাতের বড় বাছুর লাখ টাকায় কেনাবেচা হচ্ছে।
করমজা চতুরহাটে জমজমাট বাছুর বেচাকেনা-ছবি জাগো নিউজ
হাটে ব্যাপারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্রস জাতের বাছুর এবং দেশি জাতের বাছুরের চাহিদা অনেক বেশি। তবে ৫০ হাজার টাকার নিচে কোনো বাছুর মিলছে না। খামারিরা জানান, ছোট বাছুরের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি। ৫০ হাজার টাকায় যে বাছুর মিলছে এর সঙ্গে আর ৩০ হাজার টাকা বাড়িয়ে দিলে এর দ্বিগুণ ওজনের গরু কিনে পোষা সম্ভব। ক্ষুদ্র চাষিদের অল্প পুঁজি হওয়ায় তাদের শুরুতেই বাছুর কেনায় খরচ বেড়ে যায়। আর বড় খামারিদের পুঁজি বেশি হওয়ায় তারা অপেক্ষাকৃত বড় গরু কেনেন। এতে শুরু থেকেই বড় খামারিদের উৎপাদন খরচ কিছুটা কম হয়।
- আরও পড়ুন
ব্রাহমা জাতের গরু কি আসলেই বাংলাদেশে নিষিদ্ধ?
সাদিক অ্যাগ্রোর আরেক খামারে সেই ছাগল, ১০ ব্রাহমা গরুর সন্ধান
খামারি ও ক্ষুদ্র চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে বাছুর কিনে মোটাতাজাকরণ করে অনেক লাভবান হওয়া যেত। কিন্তু গো-খাদ্য ও ওষুধের দাম অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় এখন বাছুর লালন-পালন করে লাভ থাকছে না। তারা জানান, এক দশক আগেও ২০ হাজার টাকায় একটি বাছুর পাওয়া যেত। বছর শেষে তা ৮০ হাজার বা ক্ষেত্রবিশেষে লাখ টাকায় বিক্রি করা যেত। এতে ক্ষুদ্র-মাঝারি বা বড় সব শ্রেণির গো-খামারিদের লাভবান হওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু এখন দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। এখন একটি ষাঁড় বা গাভির বাছুর কিনতে হচ্ছে ৫০-৭০ হাজার টাকায়। উন্নত জাত হলে তা লাখ টাকা দিয়েও কিনতে হচ্ছে। এতে ওই সব বাছুরের পেছনে যে খরচ হয় তাতে বছর শেষে যে দরে বিক্রি হয় তাতে আর লাভ থাকে না।
খামারি ও ক্ষুদ্র চাষিরা তাদের পালন করা ষাঁড় সাধারণত কোরবানির ঈদের আগে বিক্রি করেন। দেশে ‘গোশত সমিতি’ (সমিতি করে টাকা তুলে গরু কেনা) বেড়ে যাওয়ায় রমজান মাস শেষেও প্রচুর ষাঁড় বিক্রি হয়। এসব খামারি বাছুর কিনে নতুন করে খামার সাজান। তারা সাধারণত কোরবানি ঈদের পরের হাটগুলোতে বাছুর কেনেন।
পাবনা সদর উপজেলার ভাড়ারা গ্রামের সেলিম উদ্দিন স্মৃতিচারণ করে জানান, ২০১২ সালে ২০ হাজার টাকা দিয়ে একটি বাছুর কিনে মোটাতাজা করে আরিফপুর হাজীরহাটে এক ব্যবসায়ীর কাছে ৬৬ হাজার টাকায় বিক্রি করেছিলেন। এতে তার নিট লাভ হয়েছিল ৩০ হাজার টাকা। ঈশ্বরদী উপজেলার চরগড়গড়ি গ্রামের রহিমা খাতুন, করিমন নেছা ও সুফিয়া বেগম জানান, তারা ২০১৩ সালে একটি এনজিও থেকে ২০ হাজার টাকা করে ঋণ নিয়ে বাছুর গরু কিনেছিলেন। মাত্র ৬ মাস পর তারা হাটে বিক্রি করেছিলেন ৪০ হাজার টাকায়।
পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার ছলিমপুর ইউনিয়নের সাকড়েগাড়ি এলাকার লাবণী আক্তার লাভলী জানান, ২০১৩ সালে তার স্বামী আনোয়ারুল ইসলাম ঈশ্বরদীর অরণকোলা থেকে দুটি এঁড়ে বাছুর মাত্র ১২ হাজার টাকায় কিনে এনেছিলেন। সেই দুটি বাছুর দুই বছর পুষে তারা পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করেছিলেন।
অনেকগুলো বাছুর নিয়ে হাটে এসেছেন ব্যাপারী আবুল মিয়া-ছবি জাগো নিউজ
সাঁথিয়ার বহলবাড়িয়া গ্রামের স্কুল শিক্ষক আফসার আলী ও বিষ্ণুপুর গ্রামের জালাল উদ্দিন জানান, সরকার আমাদের যে বেতন দেয় তা দিয়ে সংসার চলে না। তাই প্রতি বছর একটি করে ষাঁড় বাছুর পালন করি। কোরবানির ঈদে প্রায় লাখ টাকায় বিক্রি করা যায়।
জালাল উদ্দিন জানান, তবে এখন বাছুর পুষে লাভ হচ্ছে না। গরু লাখ টাকায় বিক্রি করলেও খরচ বাদ দিলে কোনো মুনাফা থাকছে না। তিনি গো-খাদ্য ও ওষুধের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করেন।
সাঁথিয়া উপজেলার বামনডাঙ্গা গ্রামের ভ্যান চালক বাবু আলী জানান, তিনি ৫০ হাজার টাকায় একটি বাছুর কিনে লালন-পালন করেছেন। এখন গরুর দাম লাখ টাকা। কিন্তু বাছুরের দাম আর খাবার খরচ বাদ দিলে কোনো মুনাফা থাকছে না। নিজের পরিশ্রমতো হিসেবেই আনেননি। তাহলে কী আশায় তারা বাছুর পালন করেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, দিনে দিনে খাবার খরচ লাগে। কিন্তু গরু বিক্রি করার সময় একসঙ্গে টাকাগুলো পাওয়া যায়, এটাই লাভ।
জাত ও আকার ভেদে বাছুরের দামে আছে ভিন্নতা-ছবি জাগো নিউজ
জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ জানিয়েছে, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পুরো জেলায় প্রায় ১০ হাজার খামারি রয়েছেন, যারা গাভি ও ষাঁড় পালন করেন। অন্যদিকে মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজন, কেউ শখের বশে, কেউ বেকারত্বের অভিশাপ ঘোচাতে, কেউ সংসারে সচ্ছলতা আনতে একটি-দুটি করে ষাঁড় বাছুর পালন করেন। এদের সংখ্যা প্রায় অর্ধলাখ। এবারও জেলায় কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা ছিল ৬ লাখ ৩৪ হাজার ৪১৪টি গবাদিপশু। এর মধ্যে গরু ১ লাখ ৯৩ হাজার ১০০টি। এত গরু বিক্রি হওয়ার পর বাছুর গরু দিয়ে আবার খামার শুরু হয়। আবার খাামরিরা যে শুধু কোরবানি ঈদের পর বাছুর কেনেন তা নয়, তারা পুরো বছরই কম-বেশি বাছুর কেনেন। তবে কোরবানি ঈদের পর সবচেয়ে বেশি বাছুর কেনা-বেচা হয়।
ছোট বাছুরের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি। ৫০ হাজার টাকায় যে বাছুর মিলছে এর সঙ্গে আর ৩০ হাজার টাকা বাড়িয়ে দিলে দ্বিগুণ ওজনের গরু কিনে পোষা সম্ভব। ক্ষুদ্র চাষিদের অল্প পুঁজি হওয়ায় তাদের শুরুতেই বাছুর কেনায় খরচ বেড়ে যায়। বড় খামারিদের পুঁজি বেশি হওয়ায় তারা অপেক্ষাকৃত বড় গরু কেনেন। এতে শুরু থেকেই বড় খামারিদের উৎপাদন খরচ কিছুটা কম হয়।
এদিকে বাছুর বিক্রেতারা জানান, গো-খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় গাভি পালন অলাভজনক হয়ে উঠছে। অনেকে খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। তারা জানান, গাভি পুষলে বাছুরটি লাভ হয়। বাছুরগুলো সাধারণত কোরবানি ঈদের পর কিংবা শীতের শেষে বেশি বিক্রি হয়।
আরও পড়ুন
বাছুর কেনা-বেচার সবচেয়ে বড় হাট করমজা চতুরহাটে গিয়ে কথা হয় আতাইকুল থানার বামনডাঙ্গা গ্রামের সাগর হোসেন নামের এক তরুণের সঙ্গে। তিনি জানান, তারা প্রতি বছর একটি করে বাছুর পালন করেন। এবারও কিনেছেন ৫৫ হাজার টাকা দিয়ে। তিনি আরও জানান, ছোট সাইজের বাছুরের তুলনামূলক দাম বেশি। ৭৫-৮০ হাজার টাকা দিয়ে কিনতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু পুঁজি কমের কারণে তা তিনি কিনতে পারেননি।
কথা হয় বাছুরের ব্যাপারী বাবুল মিয়ার সাথে। তিনি মাসখানেক আগে বেশকিছু বাছুর কিনেছিলেন। এখন সেগুলো হাটে তুলেছেন। তিনি জানান, বাছুরগুলোর খাবারের পেছনে অনেক ব্যয় হওয়ায় লাভ কম হচ্ছে।
বছর ঘুরে বাছুর হবে লাখ টাকার সম্পদ--ছবি জাগো নিউজ
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. গৌরাঙ্গ কুমার তালুকদার জানান, খামারি ও ক্ষুদ্র চাষিদের তারা পরামর্শ দেন বাছুর কেনার পরই সেটি অন্তত এক সপ্তাহ বাড়ির অন্য গরু থেকে আলাদা করে রাখার জন্য। এরপর ১৫-২০ দিন পর পর বাছুর চারটি টিকা দেওয়ার জন্য তারা পরামর্শ দেন। বাছুরকে স্বাভাবিক ঘাস খাওয়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মোলাসেস খাওয়াতে পারলে অল্প খরচে বাছুরটি স্বাস্থ্যবান ষাঁড় বা গাভিতে পরিণত হয়।
তিনি জানান, উচ্চমূল্যের খাদ্য এড়িয়ে কাঁচা ঘাসে খরচ কমে যায়। আর জেলাজুড়ে কাঁচা ঘাসের প্রাচুর্য রয়েছে। এতে বাছুর পালন করে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল।
এআইজে/এসএইচএস/জেআইএম