হবিগঞ্জ
টার্গেট পূরণের চক্রে সরকারি ধান সংগ্রহের তালিকার হযবরল অবস্থা
হবিগঞ্জে চলছে সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান। সম্প্রতি অনলাইনে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান উদ্বোধন করেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। তবে জেলায় ধান সরবরাহের জন্য কৃষকদের তালিকা তৈরিতে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। একজনের মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহার করে অন্যজনের নাম দেওয়া হয়েছে। যাদের ফোন নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে তাদের কেউ চাকরিজীবী, কেউ শ্রমিক, কেউবা আবার গৃহিণী, আছে চেয়ারম্যান, মেম্বারের নামও।
তবে তালিকাগুলোর বিশাল অংশই নারীর নাম এবং মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে ভরা। অনেক নম্বরই ব্যবহার হচ্ছে না। আবার অনেকগুলো বন্ধ। এ নিয়ে খাদ্য বিভাগ এবং কৃষি বিভাগ একে অপরকে দোষারোপ করছে।
আরও পড়ুন
বানিয়াচং উপজেলার উত্তর-পূর্ব ইউনিয়নের ৬৭ নম্বর তালিকায় লেখা আছে মিজানুর রহমান খানের নাম। তিনি ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। তার নামের পাশের মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করলে জানা যায় এটি শফিকুল ইসলাম নামের ওয়ার্কশপ ব্যবসায়ীর।
তিনি বলেন, ‘আমিতো কৃষক নই। আমার পেশাও কৃষি নয়। আমি কখনো সরকারি গুদামে ধান সরবরাহও করিনি। আমার নম্বর ব্যবহার করে এটি কীভাবে সম্ভব হলো। যারাই করেছে নিশ্চিত সেটি দুর্নীতি করেছে। আমি এর কিছুই জানি না। তাছাড়া আমার নামওতো মিজানুর রহমান খান নয়।’
বানিয়াচং উপজেলা সদরের দক্ষিণ-পূর্ব ইউনিয়নের তালিকার ৫৫ নম্বরে থাকা শেখ সাইফুর রহমানের নামের পাশের নম্বরে যোগাযোগ করলে জানা যায় এটি তার ছেলে শেখ এমদাদুর রহমানের। তিনি বলেন, ‘আমি জানি না কে বা কারা আমার বাবার নাম এবং আমার মোবাইল নম্বর দিয়েছে। বেশ কয়েক বছর আগে আমরা সরকারি গুদামে ধান দিয়েছি। এরপর থেকে আর কিছু বলতে পারি না। এবার আমরা কোনো আবেদনও করিনি। কেউ হয়তো দুর্নীতি করার উদ্দেশ্যে এমনটি করেছে।’
আরও পড়ুন
লাখাই উপজেলার বুল্লা ইউনিয়নের তালিকার ৫ নম্বরে থাকা সুম রাজ দাসের নামের পাশে থাকা মোবাইল ফোন নম্বরে যোগাযোগ করলে জানা যায় এটি সুনামগঞ্জ পৌরসভার নকশাকারক অদ্রি রায়ের নম্বর। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়িতো হবিগঞ্জে নয়। আমি সুনামগঞ্জ পৌরসভার নকশাকারক। এ সম্পর্কেতো আমি কিছুই জানি না। হয়তো কোথাও ভুল হয়েছে।’
করাব ইউনিয়নের তালিকায় ২ নম্বরে আবিদ মিয়ার নামের পাশে লেখা মোবাইল ফোন নম্বরে যোগাযোগ করলে জানা যায় এটি ট্রলিচালক আবুল কালামের নম্বর। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারের কারো নামই আবিদ মিয়া নয়। তাছাড়া আমার বাড়ি লাখাই সদর ইউনিয়নে। কে আমার মোবাইল ফোন নম্বর দিয়েছে সেটি আমি কীভাবে জানতে পারবো?’
এ বিষয়ে বানিয়াচং উত্তর-পূর্ব ইউনিয়ন পরিষদের টানা চারবারের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান খানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, কে বা কারা তালিকা করেছে, কীভাবে করেছে তার কিছুই জানি না। আমাদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগও করেনি। তাছাড়া আমার জীবনে অদ্যাবধি কখনো আমি সরকারি গুদামে ধান সরবরাহ করিনি। ভুলেও কখনো ধান দিয়েছি বলে মনে পড়ে না। এত বড় জালিয়াতি, আসলে এর তদন্ত হওয়া দরকার। দুষ্ট চক্রের বিচার হওয়া দরকার।
আরও পড়ুন
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) চাই থোয়াই প্রু মার্মা বলেন, তালিকা আমাদের চেক করার সুযোগ নেই। এটি জানে কৃষি বিভাগ। তাদের লোকজন মাঠে কাজ করেন। তারা চেনেন কারা কৃষক, আর কারা অকৃষক। তারাই যাচাই করবেন। আমরা শুধু তালিকা অনুযায়ী ধান সংগ্রহ করি। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। দেরি হওয়ায় হয়তো তারা টার্গেট পূরণ করার লক্ষ্যে যেভাবে পেরেছে দ্রুত তালিকা করে দিয়েছে।
তবে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক মো. নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, সরকার উন্মুক্ত করে দিয়েছেন অ্যাপসের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করার জন্য। তারা রেজিস্ট্রেশন করেন। তারপর লটারির মাধ্যমে কারা ধান দিতে পারবে তা নির্ধারণ করা হয়। এ কাজটি মূলত খাদ্য বিভাগের। তারা টার্গেট পূরণের জন্য বিভিন্ন জনকে উদ্বুদ্ধ করেন। মাঠ পর্যায়ে খাদ্য সংগ্রহ কাজটা কিন্তু তাদেরই। আমাদের দুষ্ট মানসিকতার জন্যই কিছু সুযোগ সন্ধানী লোক অবৈধ সুবিধা নেয়।
তিনি বলেন, তারা যতই বলুক আমরা কারো অবৈধ সুবিধা নেওয়ার সুযোগ করে দেবো না।
লাখাই, আজমিরীগঞ্জ ও বানিয়াচং উপজেলার তালিকা যাচাই করলে বেরিয়ে আসে জালিয়াতির আরও ভয়ানক তথ্য। তালিকার অধিকাংশই নারীর নামে ভরা। তাদের কাউকে ক্ষুদ্র, কাউকে মাঝারি এবং কাউকে বড় কৃষক হিসেবে তালিকায় উল্লেখ রয়েছে। যাদের বেশিরভাগ মোবাইল নম্বরই বন্ধ বা সচল নয়।
এফএ/এমএস