ফরিদপুর
চিকিৎসায় সুস্থ হচ্ছে সাপে কাটা রোগী, আছে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম
গত কয়েক দিন দেশজুড়ে বিরাজ করছে সাপ আতঙ্ক। বিশেষ করে আলোচনায় রাসেলস ভাইপার (চন্দ্রবোড়া)। এ নিয়ে ছড়াচ্ছে নানা রকম গুজবও। জীবন্ত রাসেলস ভাইপার ধরে আনতে পারলে পুরস্কার ঘোষণা করে বিতর্কের জন্ম দেয় ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগ। যদিও এ ঘোষণা পরে প্রত্যাহার করে।
তথ্য বলছে, জেলায় সাপে কাটা রোগী বেড়েছে। মানুষও আতঙ্কিত। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, সময়মতো হাসপাতালে এলে রোগী বাঁচানো সম্ভব। অধিকাংশ রোগীই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছে। তাদের কাছে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম মজুত আছে।
সাপে কাটা রোগীর একমাত্র প্রতিষেধক অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন। বিভিন্ন সময় রোগীর স্বজনরা অভিযোগ করেন, চিকিৎসক এ ইনজেকশন পুশ করার ঝুঁকি নিতে চান না। রোগী মারা গেলে ঝামেলার ভয় পান। কখনো রোগীকে অন্যত্র পাঠান। প্রচার-প্রচারণার অভাবে সাধারণ মানুষ জানে না বলেও মনে করেন অনেকে। তবে এসব অভিযোগ ঠিক নয় বলে জানিয়েছেন জেলা সিভিল সার্জন।
নয়টি উপজেলার প্রতিটিতে ২০-২৫ জনের চিকিৎসা দেওয়ার মতো অ্যান্টিভেনম মজুত আছে। এটা প্রতিনিয়ত আপডেট হয়। সাপে দংশন করলে ভয়ের কিছু নেই।- সিভিল সার্জন ডা. সিদ্দিকুর রহমান
ফরিদপুরের সিভিল সার্জন ডা. সিদ্দিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রচার-প্রচারণার অভাবে নয়, মূলত গ্রামাঞ্চলের মানুষের মধ্যে এখনো সেই পুরোনো ধারণা রয়েছে যে সাপে কাটলে ওঝার কাছে নিতে হয়। যার কারলে হাসপাতালে আসতে দেরি করে, চিকিৎসাসেবা প্রদানেও দেরি হয়ে যায়। ফলে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে।’
তিনি বলেন, ‘সময়মতো হাসপাতালে আসার পর চিকিৎসদের অবহেলা ও অন্যত্র পাঠানোর অভিযোগ সঠিক নয়। এক কথায় রোগী সময়মতো হাসপাতালে এলে তাদের যথাযথ চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। অনেক রোগী ও স্বজনরা অ্যান্টিভেনম নিতেও অনীহা প্রকাশ করে লিখিত অনুমতি দিতে চান না।’
চিকিৎসায় সেরে উঠছেন সাপে কাটা রোগী
সরেজমিনে জেলার কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে বেশ কয়েকজন সাপে কাটা রোগী ভর্তি পাওয়া যায়। রোববার (২৩ জুন) ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলার চর হরিরামপুর এলাকার গৃহবধূ সুরাইয়া আক্তার (২৫) প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাইরে গেলে তাকে বিষধর সাপে কামড়ায়। পরে পরিবারের লোকজন তাকে উদ্ধার করে ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডে ভর্তি করেন। সেখানে ভর্তির পর চিকিৎসা দিলে তিনি সুস্থ হন।
ওই ওয়ার্ডের সিনিয়র স্টাফ নার্স কল্পনা রানি মন্ডল জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা সাপে কামড়ানো রোগীদের প্রতি অধিক যত্নশীল। গত কয়েক দিনে সাপে কাটা রোগী বেড়েছে। প্রতিদিন গড়ে দু-তিনজন রোগী আসছেন হাসপাতালে। রোগী আসার সঙ্গে সঙ্গেই রক্ত পরীক্ষা করানো হয়। রোগীর রক্ত পরীক্ষা করানোর পর যদি দেখা যায় বিষাক্ত সাপে কামড় দিয়েছে তাহলে তাকে অ্যান্টিভেনম দেওয়া হয়।’
একই হাসপাতালে ৮ নম্বর ওয়ার্ডে গত ২২ জুন ভর্তি হন ফরিদপুর সদরের সাদীপুর এলাকার খালেক ব্যাপারীর মেয়ে সামিরা। সেখানে গত ২০ জুন ভর্তি হয়েছিলেন ফাল্গুনী (২০) নামে আরেক সাপে কাটা রোগী। অ্যান্টিভেনম পুশ ও চিকিৎসা শেষে সুস্থ হলে তাদের ছাড়পত্র দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন
- ফরিদপুরে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে কৃষকের মৃত্যু
- রাসেলস ভাইপার মারতে পারলে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা
- প্রত্যাহার রাসেলস ভাইপার ধরতে পারলে ‘৫০ হাজার টাকা পুরস্কার’ প্রত্যাহার
হাসপাতালটিতে শহিদুল মন্ডল (৪০) নামে এক কৃষকও ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডে। তিনি বলেন, ‘মাটির ঘরে ঘুমিয়ে ছিলাম। রাতে পায়ে সাপে কামড়ায় বলে মনে হয়। তাই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছি। এখন আমি সুস্থ।’
ওই ওয়ার্ডের সিনিয়র স্টাফ নার্স পুতুল বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘হাসপাতালটিতে সকাল আর রাতে বেশি সাপে কাটা রোগী ভর্তি হচ্ছেন। প্রতিদিন তিন-চারজন করে সাপে কাটা রোগী ভর্তি হচ্ছেন এ হাসপাতালে।’
সাপে কাটা নিয়ে যা বলছেন চিকিৎসকরা
ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. গনেশ কুমার আগরওয়ালা বলেন, ‘গত কয়েক মাসে সাপে কাটা রোগী বেড়েছে। তবে সুনির্দিষ্ট করে রোগীর সংখ্যা জানানো সম্ভব নয়। গড়ে প্রতিদিন দু-তিনজন রোগী চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আসেন। সম্প্রতি সাপের কাটা কোনো রোগী এ হাসপাতালে মারা যাননি। হাসপাতালে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম রয়েছে।’
রাসেলস ভাইপার সাপ নিয়ে আতঙ্কের কিছুই নেই। তারপরও গুজব না ছড়িয়ে সবাইকে সচেতন ও সাবধান থাকতে হবে। চরাঞ্চলের কৃষকদের নিরাপত্তায় শিগগির গামবুট দেওয়া হবে। বিভিন্ন স্থানে মাইকিং করা হবে। সব হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম রাখার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।- ফরিদপুরের ডিসি কামরুল আহসান তালুকদার
এ বিষয়ে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক দীপক কুমার বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাপে কাটা রোগীর পাশাপাশি গত কয়েকদিনে আতঙ্ক বেড়েছে। অনেক রোগী হাসপাতালে না এসে যান ওঝার কাছে। অপচিকিৎসা না দিয়ে দ্রুত হাসপাতালে আনতে হবে। হাসপাতালে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম রয়েছে। দ্রুত চিকিৎসা দিতে পারলে প্রাণে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। চিকিৎসকরাও সাপে কাটা রোগীর ব্যাপারে খুব যত্নশীল।’
এ বিষয়ে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এফসিপিএস (মেডিসিন), মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও সহকারী রেজিস্ট্রার (নেফ্রোলজি), ডা. শরীফুননেছা (ঝুমুর) জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাপে কাটলে আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। আক্রান্ত অঙ্গ নড়াচড়া করা যাবে না। আক্রান্ত স্থানে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করলে, রক্তক্ষরণ হলে, চোখের পাতা পড়ে গেলে, ঘাড় শক্ত রাখতে না পারলে, হাত-পা অবশ হয়ে এলে ও শ্বাসকষ্ট-বমি হলে একটুও দেরি না করে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। সাধারণত বিষমুক্ত সাপের কামড়ে আক্রান্ত স্থানে সামান্য ব্যথা, ফুলে যাওয়া বা অল্প ক্ষত সৃষ্টি হয়।’
‘আক্রান্ত স্থান কাটা, শক্ত করে বাঁধা যাবে না, আক্রান্ত স্থান থেকে মুখের সাহায্যে রক্ত বা বিষ টেনে বের করার চেষ্টা করা যাবে না, আক্রান্ত স্থানে গোবর, শিমের বিচি, আলকাতরা, ভেষজ ওষুধ বা কোনো ধরনের রাসায়নিক লাগানো যাবে না, অ্যান্টিহিস্টামিন ইনজেকশন প্রয়োগ করা, কার্বলিক অ্যাসিডজাতীয় রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে দংশিত জায়গা পোড়ানো, গাছ-গাছড়ার রস দিয়ে প্রলেপ দেওয়া যাবে না।’
এই চিকিৎসক বলেন, ‘সাপ সাধারণত দুই ধরনের- বিষাক্ত ও বিষমুক্ত। সাপের কামড়ে রোগীদের বিভিন্ন উপসর্গ দেখেও চিকিৎসা দেওয়া হয়। রাসেলস ভাইপারের কামড়ে বিভিন্ন উপসর্গের পাশাপাশি ইদানীং কিডনি বিকল হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে হিম ডায়ালাইসিস করানো হয়। সাধারণত একজন সাপে কাটা রোগীকে হাসপাতালে আনার পর প্রথমে তাকে জরুরি বিভাগে নিতে হয়।’
‘ভর্তির পরে রোগীর রক্ত পরীক্ষা করে যদি দেখা যায় রক্ত জমাট বেঁধে গেছে তাহলে বুঝতে হবে সাপটি বিষাক্ত নয়। রক্ত যদি জমাট না বাঁধে তাহলে বুঝতে হবে সাপটি বিষাক্ত এবং সেক্ষেত্রে রোগীকে অ্যান্টিভেনম দিতে হবে। রাসেলস ভাইপার, কিং কোবরা, গোখরা, কাল কেউটে সাপে কাটা রোগীর জন্য একই ধরনের অ্যান্টিভেনম দেওয়া হয়।’
অ্যান্টিভেনমের মজুত পর্যাপ্ত
ফরিদপুরের সিভিল সার্জন ডা. সিদ্দিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফরিদপুর সদর উপজেলা, ভাঙ্গা, চরভদ্রাসন ও সদরপুরের চরাঞ্চলে বিষাক্ত অন্য সাপের পাশাপাশি রাসেলস ভাইপারের উপদ্রব আছে। তবে তা মারাত্মক নয়। এখনো সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে। আতঙ্ক ছড়ানোর মতো কোনো কিছুই ঘটেনি।’
‘গত একমাসে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তবে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে কি না তাও জানা যায়নি। এতে আতঙ্কের কিছু নেই। তবে সবার সাবধানতা জরুরি। খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। জেলা শহরের হাসপাতালসহ সব উপজেলা হাসপাতালে পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যান্টিভেনম মজুত করা হয়েছে। নয়টি উপজেলার প্রতিটিতে ২০-২৫ জনের চিকিৎসা দেওয়ার মতো অ্যান্টিভেনম মজুত আছে। এটা প্রতিনিয়ত আপডেট হয়। সাপে দংশন করলে ভয়ের কিছু নেই।’
হাসপাতালগুলোর চিকিৎসকরাও যথেষ্ট সচেতন ও আন্তরিক বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) কামরুল আহসান তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘রাসেলস ভাইপার সাপ নিয়ে আতঙ্কের কিছুই নেই। তারপরও গুজব না ছড়িয়ে সবাইকে সচেতন ও সাবধান থাকতে হবে। চরাঞ্চলের কৃষকদের নিরাপত্তায় শিগগির গামবুট দেওয়া হবে। বিভিন্ন স্থানে মাইকিং করা হবে। সব হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম রাখার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
এন কে বি নয়ন/এএসএ/এএসএম