ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

সিলেটে বন্যা

‘কচুয়ারপাড়’ যেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ

আহমেদ জামিল | সিলেট | প্রকাশিত: ১১:২১ পিএম, ২০ জুন ২০২৪

৬০ বছর বয়সী ইন্তাজ আলীর বাড়ির চারপাশে অথৈ পানি। ভিটের বাইরে শুকনোতে এক কদম পা ফেলার জায়গা নেই। স্ত্রী ফয়জুন নেছা দরজার পাশে বসে কাঁঠালের শুকনো বিচি কাটছিলেন। ইন্তাজ আলী একটি টুলের ওপর বসে বসে সেটা দেখছিলেন। এমন সময় ত্রাণবাহী একটি নৌকা ভিড়তেই যেন প্রাণ ফিরে আসে ইন্তাজ আলীর। ত্রাণ নিতে দুই হাত বাড়িয়ে দেন তিনি।

এ সময় ইন্তাজ আলীর হাতে একটি ত্রাণের প্যাকেট তুলে দেন রোটারি ক্লাব অব সিলেট নর্থের সভাপতি প্রকৌশলী পনির আলম হাওলাদার। তাতে পরিবারের চাহিদা মিটবে না এমন অসহায়ত্ব প্রকাশ করে আরেকেটি প্যাকেট চেয়ে নেন ইন্তাজ আলী। ত্রাণের দুইটি প্যাকেট পেয়ে চোখে-মুখে তৃপ্তির হাসি ইন্তাজ আলীর।

ইন্তাজ আলী সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার নন্দিরগাঁও ইউনিয়নের কচুয়ারপাড় গ্রামের বাসিন্দা। তার বাড়ির মতো এই এলাকার প্রতিটি বাড়ির ভিটে ছাড়া এক টুকরো শুকনো মাটি নেই। কারও কারও ভিটেটাও পানির নিচে। তাদের ঠাঁই হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রে। নৌকা ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়ার বিকল্প কোনো পথ নেই এই গ্রামের বাসিন্দাদের। যার কারণে একমাত্র ত্রাণের দিকেই চেয়ে আছেন গ্রামের অধিকাংশ মানুষ।

সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ সড়ক থেকে অন্তত তিন কিলোমিটার দূরে কচুয়ারপাড় গ্রাম। গোয়াইনঘাট উপজেলার এই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সারিগোয়াইন নদী। শুকনো মৌসুমেও এই গ্রামের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। কাঁচা রাস্তাঘাটের কারণে যান চলাচলও হয় না খুব একটা। আর বর্ষা এলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে গ্রামটি। দূর দেখলে কচুয়ারপাড়কে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ মনে হয়।

২০ দিনের ব্যবধানে দুই দফা বন্যায় একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছেন এই গ্রামের বাসিন্দারা। গত মাসের শেষ সপ্তাহে সৃষ্ট বন্যার ক্ষত শুকানোর আগেই দ্বিতীয় দফায় বন্যায় ফের প্লাবিত হয়েছে পুরো গ্রামটি। গ্রামের অধিকাংশ ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। পরিবার পরিজন নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন বন্যা আক্রান্তরা। তবে আশ্রয়কেন্দ্রে স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেকেই বাধ্য হয়ে বাড়িতে থাকতে হয়েছে।

‘কচুয়ারপাড়’ যেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ

২০ দিনের ব্যবধানে দুই দফা বন্যায় নজিরবিহীন ভোগান্তির সাক্ষী ইন্তাজ আলী। বৃহস্পতিবার বিকেলে ইন্তাজ আলীর সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের।

তিনি বলেন, প্রথম দফা বন্যায় বাড়িঘর তলিয়ে যায়। এরপর পানি পুরোপুরি শুকিয়ে ঈদের আগের দিন থেকে পানি বাড়তে থাকে। ঈদের দিন ভিটেটাও তলিয়ে যায়। ঘরের একটি কক্ষ কোনোমতে শুকনো ছিল। সেই কক্ষেই স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে ছিলাম। গতকাল থেকে পানি কিছুটা কমায় ভিটে থেকে কিছুটা নিচে নেমেছে পানি।

তিনি বলেন, এই গ্রামে যে আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে সেখানে মাত্র দুইটি রুম রয়েছে। কয়েকটি পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন। আর কেউ থাকার জায়গা নেই।

কীভাবে দিনাতিপাত করছেন জানতে চাইলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইন্তাজ আলী বলেন, নৌকা ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়ার সুযোগ নেই। ঘরে যা খাবার ছিল সেগুলোও শেষ হওয়ার পথে। এখন একবেলার খাবার দিয়ে তিনবেলা খেতে হচ্ছে। কেউ ত্রাণ নিয়ে আসলে সেগুলো দিয়েও কোনোমতে দিনাতিপাত করছি।

একই গ্রামের উজ্জ্বল আহমদ বলেন, বাড়িঘরের সঙ্গে তলিয়ে গেছে টিউবওয়েলটিও। যার কারণে বৃষ্টির পানিই ভরসা ছিল আমাদের। কিন্তু গতকাল থেকে বৃষ্টি কম হওয়ায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এতে বাধ্য হয়ে বানের পানি পান করতে হচ্ছে।

‘কচুয়ারপাড়’ যেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ

এই গ্রামের বাসিন্দা জমির উদ্দিন বলেন, স্পিটবোট নিয়ে ‘এমপি-মন্ত্রীরা’ বাড়ির পাশ দিয়ে আসা যাওয়া করছেন। কিন্তু আমাদের কারও চোখে পড়ছে না। গ্রামের সামনের অংশে যেসব বাড়িঘর রয়েছে সেগুলোতে বেশি ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। গ্রামের ভেতরের বাসিন্দারা ত্রাণ পাচ্ছেন না।

কচুয়ারপাড় গ্রামের জমসেদ আলী বলেন, ইঞ্জিন নৌকা পেলে ঘর থেকে বের হওয়া যায়। নৌকা ছাড়া বের হওয়ার কোনো পথ নেই। নৌকা বাজার-হাট করা সম্ভব হয় না। যাদের নৌকা আছে তারা মোটামুটি চলতে পারছেন। আমরা ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল।

রোটারি ক্লাব অব সিলেট নর্থের সভাপতি প্রকৌশলী পনির আলম হাওলাদার বলেন, এই গ্রামের প্রতিটি পরিবারই অসহায় অবস্থায় রয়েছেন। গ্রামের এমন অবস্থা যারা কিছুটা স্বচ্ছল ছিলেন, তারাও এখন অসহায়। ভিটে থেকে এক পা বাইরে দিতে হলে নৌকা প্রয়োজন। এর বিকল্প কোনো পথ নেই। এই গ্রামের বাসিন্দাদের প্রতি বাড়তি নজর দেওয়া প্রয়োজন।

তিনি বলেন, আমরা অনেক খোঁজখবর নিয়ে এই এলাকায় ত্রাণ নিয়ে এসেছি। গ্রামের প্রতিটি পরিবারই ত্রাণ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু সবাইকে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য এই গ্রামের সমানভাবে ত্রাণ বিতরণের জন্য বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

আহমেদ জামিল/জেএইচ