মডেল ঘর পেয়েও চিন্তার ভাঁজ রাজবাড়ীর পেঁয়াজ চাষিদের কপালে
সারাদেশের মতো রাজবাড়ীতেও কৃষক পর্যায়ে বিনামূল্যে পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণের মডেল ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। আধুনিক পদ্ধতিতে ৬ থেকে ৯ মাস পেঁয়াজ সংরক্ষণ, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত ও আমদানি নির্ভরতা কমাতে এ উদ্যোগ দেওয়া হয়েছে।
তবে পেঁয়াজ আবাদের সমৃদ্ধ এ জেলায় উৎপাদন হিসাবে ঘরের পরিমাণ খুবই কম। দুই দফায় রাজবাড়ীর কালুখালীতে ২০টি ও বালিয়াকান্দিতে ৩০টি সহ দুই উপজেলায় ঘর তৈরি হচ্ছে মাত্র ৫০টি। যা চলতি বছর উৎপাদিত প্রায় ৫ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজের জন্য সামান্য।
মসলা জাতীয় ফসল পেঁয়াজ আবাদের সমৃদ্ধ জেলা রাজবাড়ী। সারাদেশের প্রায় ১৬ শতাংশ পেঁয়াজ উৎপাদন হয় এ জেলায় এবং উৎপাদনে দেশের তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে রাজবাড়ী। জেলার ৫ উপজেলায় কম বেশি পেঁয়াজের আবাদ হলেও কালুখালী, বালিয়াকান্দি ও পাংশায় উল্লেখযোগ্য হারে আবাদ হয়। জেলার উৎপাদিত পেঁয়াজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় বেশিরভাগ কৃষক ভরা মৌসুমেই অল্প দামে বিক্রি করে দেন। আর অল্প সংখ্যক কৃষক নিজস্ব উপায়ে সংরক্ষণ করলেও থাকেন নানা জটিলতায়।
জানা গেছে, পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণ পদ্ধতি আধুনিকায়ন এবং বিপণন কার্যক্রম উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কৃষক পর্যায়ে বিনামূল্যে কংক্রিটের পিলারের ওপর ২৫ ফুট লম্বা ও ১৫ ফুট চওড়া বাঁশ-কাঠের মাধ্যমে ৩ স্তরের মাচালি দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণ মডেল ঘর। যার প্রতিটি ঘরের খরচ ধরা হয়েছে সাড়ে ৪ লাখ টাকা।
নিয়মানুযায়ী প্রতিটি ঘরে ৫ জন কৃষক যৌথভাবে শুধুমাত্র বিদ্যুৎ বিল প্রদানের মাধ্যমে প্রায় ৩০০ মণ পেঁয়াজ ৬ থেকে ৯ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে পারবেন। প্রথম দফায় রাজবাড়ীর কালুখালীতে ২০টি ঘর নির্মাণের পর পেঁয়াজ রেখেছেন চাষিরা এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে বালিয়াকান্দিতে তৈরি হচ্ছে আরও ৩০টি ঘর। সম্পূর্ণ কাজ শেষ হলে আনুষ্ঠানিকভাবে কৃষকদের কাছে ঘরগুলো হস্তান্তর করা হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জেলায় ৩৫ হাজার ৬৭৫ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আবাদ হয়েছে প্রায় ৩৬ হাজার হেক্টর জমিতে এবং উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৫ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ।
বালিয়াকান্দির রাজধরপুরের পেঁয়াজচাষি আলিমুজ্জামান খান ও আরিফুর রহমান বলেন, তাদের এলাকায় প্রায় প্রতিটি বাড়ির কৃষক পেঁয়াজ চাষ করেন এবং শত শত মণ পেঁয়াজ পান। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে মৌসুমের শুরুতে অল্প দামে বিক্রি করে দেন। এতে তাদের লোকসান হয়। সরকার থেকে পেঁয়াজ রাখার যে মডেল ঘর তৈরি করে দিচ্ছে তাতে দীর্ঘদিন পেঁয়াজ ভালো থাকবে এবং পরে বেশি দামে বিক্রি করতে পারবেন। কিন্তু তাদের এলাকায় বেশিরভাগ কৃষক ঘর পাননি। ফলে আগের মতো এখনো তারা তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করে রাখছেন। যার কারণে অনেক পেঁয়াজ পচে নষ্ট হয়ে যায় এবং কম দামে বিক্রি করতে হয়। সরকারিভাবে পেঁয়াজ রাখার ঘর তাদের এলাকায় প্রায় প্রতিটি কৃষকের প্রয়োজন।
পেঁয়াজ সংরক্ষণের ঘর পাওয়া কৃষক লুৎফর রহমান, আব্দুল গফুর মোল্লা, মোকছেদ মোল্লা ও কংকন কুমার মন্ডল বলেন, আগে তাদের উৎপাদিত পেঁয়াজ গরুর ঘর, রান্না ঘর, শোবার ঘরে রাখতেন। অরেক পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যেতো। সংরক্ষণের ভালো ব্যবস্থা না থাকায় অল্প দামে মৌসুমের শুরুতেই বিক্রি করে দিতেন। এতে তাদের লোকসান হতো। কিন্তু এখন এই ঘরে পেঁয়াজ রাখতে পারলে যেমন দীর্ঘদিন ভালো থাকবে, তেমনি ভালো দামও পাবেন।
তারা জানান, এই ঘর পেয়ে তারা উপকৃত হলেও নিয়ম অনুযায়ী ৫ জন কৃষক একটি ঘরে ৩০০ মণ পেঁয়াজ রাখতে পারবেন। কিন্তু তারা একজন কৃষকই ৩০০ মণের বেশি পেঁয়াজ পান। ফলে এই ঘর তাদের জন্য যথেষ্ট না। প্রায় প্রতিটি কৃষকের একটি করে ঘর প্রয়োজন। মডেল ঘরে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করে রাখতে পারলে তারা লাভবান হবেন।
রাজবাড়ী জেলা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাঠ কর্মকর্তা মো. রাজিব খান বলেন, কালুখালীতে ২০টি পেঁয়াজ সংরক্ষণের মডেল ঘর নির্মাণ করে হস্তান্তরের পর এবার বালিয়াকান্দিতে ৩০টি ঘর নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। এরমধ্যে হস্তান্তরের আগেই ১৫টি ঘরে কৃষকরা পেঁয়াজ রাখা শুরু করেছেন। মূলত কৃষকের উৎপাদিত পেঁয়াজ পচনরোধ ও সংরক্ষণের জন্য কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ঘরগুলো বিনামূল্যে তৈরি করে দিচ্ছে। সারাদেশের ৩০০ ঘরের মধ্যে রাজবাড়ীতেই ৫০টি। তবে কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী এই জেলার বালিয়াকান্দি, কালুখালী, পাংশায় প্রচুর ঘর প্রয়োজন। যে কারণে তারা পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য এ উদ্যোগ নিয়েছেন।
তিনি বলেন, মৌসুমে পেঁয়াজ রাখা বা সংরক্ষণের জায়গা না থাকায় কৃষক অল্প দামে বিক্রি করে দেন। কিন্তু এই ঘরে ৬ থেকে ৯ মাস কৃষক পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে পারবেন। এর ফলে কৃষকরা ভালো দাম পাবেন এবং আমদানির ওপর চাপ কমবে।
রাজবাড়ী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, এ বছর জেলায় প্রায় ৫ লাখ মেট্রিকটন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। উৎপাদনের বেশির ভাগ কৃষক প্রচলিত পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে থাকেন। বর্তমানে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কালুখালীতে ২০টি পর এবার বালিয়াকান্দিতে ৩০টিসহ মোট ৫০টি মডেল ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছে, তা মোট পেঁয়াজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সামান্য। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, সেটি অনুমোদন হলে জেলার সব উপজেলায় এরকম মডেল ঘর নির্মাণ সম্ভব হবে। এর জন্য কৃষি বিপণন অধিদপ্তরকে তাদের প্রকল্প সম্প্রসারণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
এফএ/এএসএম