গরিব মায়েদের আশ্রয়স্থল ডা. দিলরুবা ফেরদৌস
দুই যুগ ধরে মাদারীপুরের মায়েদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছেন গরিবের ডাক্তার খ্যাত দিলরুবা ফেরদৌস। কেউ নতুন মা হবেন বা কেউ মা হতে পারছেন না কিংবা কোনো মায়ের চিকিৎসার জন্য টাকা নেই, ওষুধ কিনতে পারছেন না এমন নানা সমস্যায় মাদারীপুরের নারীদের প্রথম আশ্রয়স্থল ডা. দিলরুবা ফেরদৌস।
মাদারীপুর শহরসহ প্রত্যন্ত গ্রামগুলো থেকে চিকিৎসা নিতে আসা নারীরা চিকিৎসক দিলরুবা ফেরদৌসের ব্যবহার ও আন্তরিকতার জন্য বারবার ছুটে আসেন আচমত আলী খান সেন্ট্রাল হাসপাতালে। হাসিমুখে দীর্ঘ সময় নিয়ে শোনেন রোগীদের সমস্যার কথা। সবার সঙ্গেই হাসিমুখে কথা বলেন। এছড়াও গরিব রোগীদের বিনামূল্যে দেন চিকিৎসাপত্র। গরিব রোগীদের ওষুধ কেনার জন্য করে থাকেন আর্থিক সহযোগিতাও। শুধু ওষুধ নয়, বিভিন্ন সময় দুস্থদের নানা ধরনের সহযোগিতা করে থাকেন এই নারী চিকিৎসক। তবে চেয়ে কখনো ফি নিতে দেখা যায়নি তাকে। সামর্থ্য অনুযায়ী যে যা দেন, তাতেই তিনি খুশি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দিনাজপুরের পার্বতীপুরের ইংরেজি শিক্ষক মৃত কফিল উদ্দিন আহম্মেদের মেয়ে ডা. দিলরুবা ফেরদৌস। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। শ্বশুরবাড়ি যশোর শহরে। স্বামীও ছিলেন একজন চিকিৎসক। ২০১৪ সালে স্বামী ডা. এসএম আলীমুর রেজা ব্রেইনস্ট্রোকে মারা যান। এক মেয়ে ও এক ছেলে তার।
সপ্তাহের দুদিনই থাকেন মাদারীপুর শহরের আচমত আলী খান সেন্ট্রাল হাসপাতালে। বাকি পাঁচদিন থাকেন ঢাকার গ্রিন রোড এলাকায়। বর্তমানে তিনি ঢাকার মিরপুরে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে সিনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে কর্মরত আছেন। তার মেয়েও একজন ডাক্তার।
এমবিবিএস, এফসিপিএস, ডিজিও, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমএস কোর্সের (অবস্ অ্যান্ড গাইনি) থিসিস শেষ করে জরায়ু ক্যানসার রোগ নিয়ে গবেষণার কাজ করেছেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ও সার্জন ডা. দিলরুবা ফেরদৌস। এরআগে তিনি দীর্ঘ বছর মাদারীপুরের শকুনী লেকপাড়ের চৌধুরী ক্লিনিকে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে এসেছেন।
১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মাদারীপুরের মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে স্বামী-স্ত্রী দুজন একসঙ্গে কাজ করেছেন। তাদের দুজনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ওই সময় মাদারীপুর জেলা ছাড়াও আশপাশের জেলাগুলো থেকে রোগী আসতেন। ২০০৫ সালে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র ঢাকার আয়োজনে সারা বাংলাদেশের মধ্য থেকে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক হিসেবে পুরস্কার পান দিলরুবা ফেরদৌস। এছাড়াও ২০০৬ সালে ওজিএসবির গাইনি অব সোসাইটিতে শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক হিসেবে সম্মাননা পান।
দিলরুবা ফেরদৗস বলেন, আমার স্বামী মরহুম ডা. এসএম আলীমুর রেজার কাছ থেকেই মানুষকে ভালোবাসতে শিখেছি। তিনি বলতেন একজন চিকিৎসকের উচিত গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে থাকা। বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া। তার সেই কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আজও গরিব-দুঃখীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ দেওয়ার পাশাপাশি নানাভাবে আর্থিক সহযোগিতা করে আসছি এবং সারাজীবন এই কাজগুলো করে যাবো। তাই দীর্ঘমেয়াদি ও ধারাবাহিকভাবে এই কাজগুলো করার জন্য আমার স্বামীর নামে একটি সংস্থা খুলতে চাই। সেই সংস্থা হবে গরিব-দুঃখীর আশ্রয়স্থল।
ডা. দিলরুবা ফেরদৌস আরও বলেন, আমার বাড়ি মাদারীপুরে না হলেও এই জেলার মানুষদের প্রতি আমার অনেক মায়া, অনেক ভালোবাসা। সেই ১৯৯৯ সাল থেকে সাত বছর আমি ও আমার স্বামী মিলে একসঙ্গে কাজ করার সুবাদে ভালোবাসার জন্ম হয়। সেই ভালোবাসার টানে প্রায় দুই যুগ ধরে মাদারীপুরে চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছি। বর্তমানে নিজের কাজ ও পড়াশোনাসহ ছেলে-মেয়েদের জন্য ঢাকায় থাকলেও প্রতি বৃহস্পতি ও শুক্রবার মাদারীপুরে আসি। তবে যদি কোনো মা জটিল সমস্যার মধ্যে পড়েন, তাহলে প্রয়োজন অনুযায়ী চলে আসি। আবার ওইদিনই ঢাকায় ফিরে যাই। আজীবন এখানে এসে এভাবেই মায়েদের সেবা দিতে চাই।
তানমিরা জেবু নামে এক রোগী বলেন, আমি যখন প্রথম মা হই, তখন তার কাছেই যাই। সন্তার হওয়ার সময় ব্যথায় প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল। তখন আমার মা, বোন ও স্বামী ডাক্তারকে বারবার সিজার করতে বলছিলেন। কিন্তু তিনি সিজার করেননি। যেখানে অন্য ডাক্তারদের কাছে গেলেই সিজার করতে বলেন, সেখানে আমরা বলার পরও তিনি সিজার করেননি। পরে স্বাভাবিক নিয়মেই আমার প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। এজন্য ডাক্তারের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
মাদারীপুরের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক মাহমুদা আক্তার কণা বলেন, আমার দেখা একজন সৎ ও ভালো ডাক্তার দিলরুবা ফেরদৌস। তিনি প্রায় সময় গরিব রোগীদের বিনামূল্যে দেখেন। আমি অনেক গরিব রোগী পাঠিয়েছি। তিনি ফি ছাড়াই দেখেছেন। গত প্রায় ২৫ বছর ধরে তিনি মায়েদের সেবা দিয়ে আসছেন। তার হাতে অসংখ্য নারী মা হয়েছেন। এটা আমাদের মাদারীপুরের জন্য গর্বের।
এফএ/এমএস