দিন চলে না চর্মকারদের
মাদারীপুর শহরের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র পুরানবাজার এলাকার একটি অংশ ‘মুচিবাড়ির মোড়’ বলে পরিচিত। এর কারণ অনেক আগে সেখানে চর্মকার সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস ছিল। আগে রাস্তার দুই পাশে একসঙ্গে শতাধিক চর্মকারকে কাজ করতে দেখা যেতো। কালের বিবর্তনে এখন আর সেই দৃশ্য চোখে পড়ে না। শহরজুড়ে ২০-২৫ জনের মতো চর্মকারের দেখা মিলবে। আর যারা এখনো এ পেশায় আছেন, তারা কষ্টে দিনযাপন করছেন। পাশাপাশি অনেকেই বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন।
সম্প্রতি দেখা যায়, শহরের ডিসি ব্রিজ, লেকপাড়, থানার মোড়, সুমন হোটেল, পুরানবাজার, কাঁচাবাজার, রেন্ডিতলাসহ বিভিন্ন জায়গায় চর্মকাররা খোলা জায়গায় বসে জুতা সেলাই ও পালিশের কাজ করছেন।
কথা হয় শহরের লেকপাড়ের দক্ষিণ দিকে হাজী মহসিন সড়কের মুচিবাড়ির মৃত উপেন ঋষির ছেলে শ্যামল ঋষির (৫০) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই চর্মকারের কাজ করে আসছি। প্রথমে বাবার সঙ্গে কাজ শুরু করি। তার কাছ থেকেই কাজ শিখে আজও এ পেশায় আছি।’
শ্যামল ঋষি বলেন, ‘এক ছেলে ও দুই মেয়েকে অনেক কষ্টে বড় করেছি। বড় মেয়ে এসএসসি পাস করার পর বিয়ে দিয়েছি। আরেক মেয়ে এবার সষ্ঠ শ্রেণিতে উঠবে। ছেলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। ওদের মা শিল্পী রানি মারা যাওয়ার পর আমি একাই সংসারের হাল ধরেছি।’
তিনি বলেন, ‘সকাল ৯টায় কাজের জন্য বের হয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরি। সারাদিন শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ৩০০-৫০০ টাকার মতো পাই। তা দিয়েই সংসারের খাবার, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, চিকিৎসাসহ সবকিছু জোগাড় করতে হয়। অনেকে এই কাজ ছেড়ে দিচ্ছে। যারা এখনো আছে তারা কেউ ভালো নেই। তারা কোনোরকম বেঁচে আছে।’
আরও পড়ুন:
- পেটের দায়ে রিকশা চালান ৮০ বছরের কানাই মাতুব্বর
- ৭ দশক ধরে কামার পেশায় মজিবর রহমান
- শরবত বিক্রির টাকায় চলে সংসার, ৫ ভাইবোনের পড়ালেখার খরচ
কথা হয় একই এলাকার জীবন ঋষির ছেলে কার্তিক ঋষির (৫২) সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন আর আগের মতো কেউ জুতা, স্যান্ডেল সেলাই করে না। আগে শুধু সেলাই না; আমরা জুতা, স্যান্ডেল তৈরিও করতাম। এখন দুই চারটা জুতা, স্যান্ডেল সেলাই-কালি করার কাজ পেলেও কেউ আমাদের দিয়ে তৈরি করায় না। এখন সবাই আধুনিক ডিজাইনের জুতা, স্যান্ডেল পরে। তাই আমাদের এখন আর কদর নেই।’
তিনি বলেন, ‘সারাদিন কাজ করে যে টাকা পাই তা দিয়ে সংসার চালানোই কষ্ট। বাবা-দাদার পেশা, ছাড়তেও পারি না। তাছাড়া ছোটবেলা থেকে এই কাজই শিখেছি। অন্য কোনো কাজ করবো, এ বয়সে তাও সম্ভব না।’
শহরের পুরানবাজার কাঁচামাল এলাকায় প্রতিদিন একটি আড়তের সামনে বসেন মহাদেব ঋষি (৪৫)। তিনি বলেন, ‘বাব-দাদার পেশা, তাই ছাড়তে পারি না। সারাদিন কাজ করে ৪০০-৫০০ টাকার মতো পাই। ঝড়-বৃষ্টি, গরম বা বেশি শীত পড়লে কাজ হয় না। ছেলেমেয়েদের স্কুলে দিয়েছি। এই টাকা দিয়ে সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়। ভাবছি আমার ছেলেকে এই পেশায় আনবো না। সে পড়াশোনা করে অন্য কোনো পেশায় যাক।’
বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে এখন চাকরি করছেন পরিতোষ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার বাব-দাদা এই কাজ করতেন। তাদের অনেক কষ্ট করতে দেখেছি। তাই আমি কিছুদূর পড়াশোনা করে চাকরি করছি। এখন আমরা ভালো আছি। আমার ভাইও অন্য কাজ করেন। আমার সন্তানদের পড়াশোনা করিয়ে অন্য পেশায় কাজ করাবো।’
শহরের বেশ কয়েকজন চর্মকারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগের মতো এ পেশায় এখন কদর নেই। আগে বহু লোক কাজ করলেও এখন শহরের মধ্যে খুব জোর ২০-৩০ জনের মতো আছেন। তাও তারা নানা প্রতিকূলতার মধ্যে যুদ্ধ করে পেশাটা ধরে রেখেছেন।
পরিবেশ নিয়ে কাজ করা স্থানীয় সংগঠন ফ্রেন্ডস অব নেচারের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক রাজন মাহমুদ বলেন, “একসময় পুরানবাজারের ‘মুচিবাড়ি মোড়’ এলাকায় সারিবদ্ধভাবে চর্মকাররা বসে কাজ করতেন। কালের বিবর্তনে এখন সেই দৃশ্য হারিয়ে গেছে। এখন অল্পকিছু চর্মকার এ পেশায় আছেন। অনেকেই এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। আসলে পেশাটি বরাবরই অবহেলিত। পেশাটি বাঁচাতে সরকারের সহযোগিতা দরকার।”
প্রাবন্ধিক, লোকসংস্কৃতি ও ইতিহাস গবেষক সুবল বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, প্রায় সোয়া দুইশ বছর আগে চর্মকার সম্প্রদায়ের পূর্বপুরুষরা পদ্মা নদীর ওপার থেকে যেমন-বিক্রমপুর, মানিকগঞ্জ, দোহার, কলাকোপা বান্ধুরা থেকে মাদারীপুরের বিভিন্ন স্থানে এসে বসবাস শুরু করেন। বর্তমানে এরা মাদারীপুর শহরের শহীদ মানিক সড়ক, চরমুগরিয়া, পুরানবাজার, কেন্দুয়া, বাজিতপুর, কুনিয়া, শ্রীনদী, কালকিনির কালীগঞ্জ কানাইপুর, ঘোষেরহাট, শশীকর, শিবচর চরশ্যামাইল, পাচ্চর, ঠাকুরবাজার, চান্দেরচর, উপেদপুর, শেখপুর, উৎরাইল, রাজৈর, টেকেরহাটসহ জেলার আরও অনেক জায়গায় বসবাস করেন।
তিনি বলেন, দিন দিন আধুনিকতায় ছোঁয়ায় এ সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের আদি পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। যে কারণে চর্মকারের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মো. মারুফুর রশীদ খান বলেন, পেশাটা অনেক পুরোনো। এখনো শহরের ব্যস্ততম জায়গায় এ পেশার মানুষগুলো দেখা যায়। তারা যদি কোনো সহযোগিতার জন্য আসেন, তাহলে আমি যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করবো।
এসআর/এএসএম