বন্ধু চেয়ারম্যান প্রার্থী, প্রচারণা চালাচ্ছেন এমপি
শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনে প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে শেরপুর-৩ আসনের (ঝিনাইগাতী-শ্রীবরদী) এমপি এডিএম শহীদুল ইসলামের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি সংসদ সদস্য এডিএম শহীদুল ইসলামের বাসায় ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও উপজেলাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় ঝিনাইগাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শ্রী বিশ্বজিৎ রায়ের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য তার বক্তব্য প্রদানের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে স্থানীয় নেতাকর্মী, সাধারণ ভোটার ও অন্যান্য প্রার্থীদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
আগামী মে মাসে ঝিনাইগাতী উপজেলা পরিষদের ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এতে চেয়ারম্যান পদে সাতজনের মনোনয়ন বৈধ ঘোষণা করেছেন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা। এবারের নির্বাচনে কোনো দলীয় প্রতীক না থাকায় সকল প্রার্থীই স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। ঝিনাইগাতী উপজেলায় সাত প্রার্থীর মধ্যে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী থাকলেও ঝিনাইগাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ রায়ের পক্ষে সরাসরি প্রকাশ্যে অবস্থান করে প্রচারণা করছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য এডিএম শহীদুল ইসলাম। ঈদের আগে বিভিন্ন ইফতার মাহফিল এবং ঈদ পরবর্তী সময়ে পুনর্মিলনী ও মতবিনিময় সভায় তিনি নিজের বন্ধু পরিচয় দিয়ে বিশ্বজিৎ রায়ের পক্ষে সবাইকে কাজ করতে হাত তুলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করছেন।
স্থানীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, নির্বাচন প্রতিযোগিতাপূর্ণ করতে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড থেকে নানাবিধ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল দলীয় ও স্বতন্ত্র এমপিদের। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কোনো প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়া যাবে না। কিন্তু আমাদের এমপি বিষয়টি মানছেন না। উপজেলায় একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রাখতে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে সমর্থন দিচ্ছেন তিনি। এছাড়া তিনি শুধু মৌন সমর্থনই নয়, প্রকাশ্যে তার বন্ধু পরিচয় দিয়ে শ্রী বিশ্বজিৎ রায়ের পক্ষে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন। এমনকি দুই হাত তুলে সবাইকে জোরপূর্বক ওয়াদাও করাচ্ছেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঝিনাইগাতী আওয়ামী লীগের এক প্রবীণ নেতা জাগো নিউজকে বলেন, গেলো সাত জানুয়ারি নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে আমাদের এমপি জয়ী হন। নির্বাচনের পর একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। আমাদের উপজেলায় আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা এবার প্রার্থী হতে চেয়েছেন। বিভিন্নভাবে কয়েকজনকে মনোনয়ন পত্র দাখিলের আগেই থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম, এমপি সাহেব তৃণমূলের কথা ভাববেন। তিনি নিজের দাপট বজায় রাখার জন্য এবং এই উপজেলায় তার অবস্থান ঠিক রাখার জন্য নিজের বন্ধুকে প্রার্থী হিসেবে সমর্থন দিচ্ছেন। যা আমাদের দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি একটা কাজ। হাইকমান্ড থেকে এর সুষ্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে। এই কাজের মাধ্যমে নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের তৃণমূলে সৃষ্ট বিরোধ আরও বাড়বে।
এদিকে শনিবার (২০ এপ্রিল) রাতে জেলা শহরের গৌরীপুর মৈত্রীবাড়ি মাঠে বিশাল প্যান্ডেল বেঁধে ঝিনাইগাতীর বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে আয়োজিত এক সভায় এমপি ওই প্রার্থীকে নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, তার প্রতি আমার আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে। তাই সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করলে তিনি নির্বাচিত হয়ে আসবেন। তিনি নির্বাচিত হলে তার মাধ্যমে আমি আপনাদের কাজ করতে পারবো। সেইসঙ্গে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাকে উপহার হিসেবে তুলে দিতে পারবো ইনশাআল্লাহ।
ওই সভায় উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী বিশ্বজিৎ রায়সহ আওয়ামী লীগ দলীয় ইউপি চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক, শাহাদাৎ হোসেন ও রুকনুজ্জামান পলাশ এবং বিএনপিদলীয় ইউপি চেয়ারম্যান আতাউর রহমান ও মো. জাহাঙ্গীর আলমসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের ইউপি সদস্য, আওয়ামী লীগের উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের ৩ শতাধিক নেতা-কর্মী অংশ নেন।
একইভাবে শুক্রবার শেরপুর শহরের মৈত্রীবাড়ি মাঠে ঈদ পুনর্মিলনীর নামে দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে সভা-সমাবেশ করেছেন সংসদ সদস্য এডিএম শহিদুল ইসলাম। ওই সভায় অন্যান্যের মধ্যে চেয়ারম্যান প্রার্থী বিশ্বজিৎ রায়, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা, জেলা পরিষদের প্যানেল মেয়র আবু তাহের, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চাঁন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক বেলায়েত হোসেন, উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি আবুল কালাম আজাদসহ স্থানীয় বিপুল সংখ্যক দলীয় নেতা-কর্মী অংশ নেন।
এদিকে দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে একজন প্রার্থীর পক্ষে দলীয় সংসদ সদস্য এডিএম শহিদুলের সরাসরি অবস্থান নেওয়ার বিষয়ে ঝিনাইগাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও চেয়ারম্যান প্রার্থী এসএম আমিরুজ্জামান লেবু বলেন, এবারের নির্বাচন উন্মুক্ত থাকায় দলীয় মন্ত্রী-এমপিদের কারও পক্ষে কাজ না করতে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের নির্দেশনা থাকলেও স্থানীয় সংসদ সদস্য চেয়ারম্যান প্রার্থী বিশ্বজিৎ রায়কে বিভিন্ন সভায় নিজের বন্ধু বলে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তার পক্ষে কাজ করার জন্য ওয়াদা করাচ্ছেন। এটি দলীয় সিদ্ধান্তের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ বিষয়ে তিনি দলীয় দপ্তরে লিখিতভাবে অভিযোগ জানাবেন। স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনে একজন সংসদ সদস্য নিরপেক্ষ বা নীরব না থাকলে নির্বাচনে অবশ্যই প্রভাব পড়বে।
একই কথা জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অপর প্রার্থী ঝিনাইগাতী উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ফারুক আহমেদ। তিনি বলেন, সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম তার পছন্দের প্রার্থী বিশ্বজিৎকে জেতাতে দলীয় নেতা-কর্মীদের ডেকে নিয়ে এবং সভা করে নানা প্রলোভন দেখিয়ে তার পক্ষে কাজ করার জন্য প্রভাবিত করছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি এবারের দলীয়ভাবে উন্মুক্ত থাকা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছেন। এজন্য আমি নিন্দা প্রকাশ করে তার বিষয়ে দলের কেন্দ্রীয় নেতা বিশেষ করে ময়মনসিংহ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
তবে এ বিষয়ে চেয়ারম্যান প্রার্থী বিশ্বজিৎ রায় বলেন, বর্তমান সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম আমার বন্ধু মানুষ। তার সহযোগিতায় যদি আমি নির্বাচিত হতে পারি উপজেলার সব সমস্যার সমাধান করবো। সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান আর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যদি একমুখী থাকে তাহলে অবশ্যই আমরা অবহেলিত ঝিনাইগাতীর উন্নয়ন করতে পারবো।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের ভেতরে অন্য কোনো প্রার্থী নেই। বিচ্ছিন্নভাবে দু’একজন রয়েছেন। তবে এমপির সমর্থন দলের নেতা হিসেবে আমার প্রতিই রয়েছে।
এ বিষয়ে সংসদ সদস্য এডিএম শহিদুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমার নির্বাচন পরবর্তী কর্মীদের নিয়ে বসা হয়নি। তাই ঈদের পর পুনর্মিলনী করেছি। সেখানে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কিছু কথা হয়েছে স্বীকার করে তিনি বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করার স্বার্থে তিনি ঢাকায় চলে যাবেন।
এ উপজেলায় এখন পর্যন্ত টিকে থাকা চেয়ারম্যান প্রার্থীদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ৩, বিএনপির ৩ ও জাসদের একজন প্রার্থী রয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী প্রথম ধাপে ৮ মে এ উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
ইমরান হাসান রাব্বী/এফএ/এমএস