চাঁপাইনবাবগঞ্জে অর্ধেকে নামতে পারে আম উৎপাদন
আমের জন্য সারাবিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। তবে এ বছর গাছে মুকুল এসেছিল কম। সেই অল্প মুকুল নিয়েও চাষিদের মনে টিমটিম করে জ্বলছিল কিছুটা আশার আলো। কিন্তু সম্প্রতি চৈত্রের বৃষ্টিতে ঝরে গেছে এসব আমের মুকুল। ফলে পর্যাপ্ত গুটি আসেনি গাছে। আর কিছু গাছে এসেছে কচিপাতা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার অর্ধেকে নামতে পারে এই জেলার আম উৎপাদন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে জেলার অর্থনীতি। ক্ষীণ হবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের হিসাব।
চলতি বছর জেলায় মোট ৪ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। যা গত বছরের তুলনায় ২৫ হাজার মেট্রিক টন বেশি।
তবে মাঠ পর্যায়ের চিত্র একেবারে ভিন্ন। চাষিরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার অর্ধেকে নেমে আসবে আম উৎপাদন। কারণ এবার ৬০-৬৫ শতাংশ গাছেই আমের গুটি নেই।
শিবগঞ্জ উপজেলায় একটি প্রথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করেন এমদাদুল হক। তিনি বলেন, আমরা পারিবারিক ভাবেই আম ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আমার দাদা-বাবা সবাই এই আম ব্যবসা করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় আমিও এই কাজ করে যাচ্ছি ১৫ বছর ধরে। কিন্তু গত ৪-৫ বছর ধরে লোকসান গুণতে গুণতে পুঁজি প্রায় শেষ।
তিনি আরও বলেন, গত বছর আমার প্রায় গাছে মুকুল এসেছিল। আমও হয়েছিল। কিন্তু তেমন দাম পাইনি। আর এবার গাছে মুকুল অনেক কম। তারপরও কয়েকদিন আগে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। আমের সব গুটি, মুকুল পচে গেছে। এমনকি এখন প্রায় আম গাছ দেখে মনে হচ্ছে একটিও আম হবে না। এতে আমি দুশ্চিন্তায় আছি।
শিবগঞ্জ ইসরাইল মোড় এলাকায় বসিন্দা আব্দুল মান্নান বলেন, আমার এ বছর প্রায় ৬ বিঘা জমিতে বিভিন্ন জাতের আম বাগান রয়েছে। যে মুকুলগুলো আগে এসেছিল সেগুলোতে কিছু আম আছে। কিন্তু যে মুকুলগুলো পরে ফুটেছে সেগুলোতে একটিও আমের গুটি নেই। মুকুল সব পচে গেছে।
সদর উপজেলার আমচাষি ইসারুল ইসলাম বলেন, আমার সংসার চলে আমের টাকায়। কিন্তু এবার আমার গাছে আম নেই। বৃষ্টিতে সব নষ্ট হয়ে গেছে। ঈদে হাসিমুখে থাকতে চেয়েছিলাম। বাগান দেখতে এসে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। বালাইনাশকের টাকা কীভাবে দেবো সেটা নিয়ে চিন্তায় আছি।
সারাদেশের সবচেয়ে সুমিষ্ট আম উৎপাদন হয় শিবগঞ্জ উপজেলায়। এই উপজেলার শ্যামপুর ইউনিয়নের বসিন্দা রইসুদ্দিন আমল। তিনিও আম চাষ করছেন প্রায় ২০ বছর থেকে।
তিনি জানান, এর আগেও আমে লোকসান করেছি। কিন্তু এবার আমের বাগান দেখে মনে হচ্ছে বেশি লোকসান হবে। কারণ বাগানে আম দেখতেই পাচ্ছি না।
তিনি আরও বলেন, আমার একটি গোপালভোগ জাতের আমগাছ আছে। প্রতিবছর এই গাছে আম হয় প্রায় ২৫-৩০ মণ। এবারও মুকুল এসেছিল প্রচুর। কিন্তু আম হয়নি। কারণ মুকুলটা যখন ফুটন্ত তখন বৃষ্টি হয়। আর এতে পচে গেছে সব মুকুল।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ ম্যাঙ্গো ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব আহসান হাবিব বলেন, জেলায় সব চেয়ে বেশি আম উৎপাদন হয় শিবগঞ্জে। কিন্তু এবার শিবগঞ্জে আমের অবস্থা খুবই খারাপ। আমাদের চাষিদের আম বিক্রি করে কীটনাশক খরচ উঠবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
তিনি আরও বলেন, এবার আম বাগানে রোগ-বালাইও বেশি। এই রোগ-বালায়ের কারণে আমের গুটি ঝরে যাচ্ছে।
শিবগঞ্জ ম্যাংগো প্রোডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন শামীম খান বলেন, এ বছর শীতের প্রকোপ অনেক বেশি ছিল। আর জলবায়ু পরিবর্তন হয়েছে। মূলত এ কারণেই বাগানে মুকুল কম। আর বৃষ্টিতে আমের মুকুলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বৈরি আবহাওয়া আমের জন্য হুমকি। আমের যখন প্রথম মুকুল আসে তখন থেকেই শঙ্কায় ছিলাম। দেরিতে আসা মুকুলের কোনো ভরসা নেই। সবশেষ বৃষ্টিতে আমের মুকুল ঝরে গেছে। এজন্য আমাদের উপজেলায় প্রায় গাছেই আম নেই। আশা করছি জেলায় ৪০ শতাংশ গাছে আম হতে পারে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক পলাশ সরকার বলেন, যেহেতু গত বছর আম গাছে প্রচুর মুকুল ছিল, তাই এ বছরকে অফ সিজন বলা যায়। তবে শীতের প্রকোপে বিশেষ করে বড় গাছে আমের মুকুল কম এসেছিল। তারপরও কয়েকদিন আগে ঘন কুয়াশা, অতিরিক্ত বৃষ্টি হয়েছে। এতে আমের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এবার যে বিরূপ আবহাওয়া চলছে, এতে আমের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। এমনকি সামনে আরও প্রকৃতিক দুর্যোগ আছে। যেমন কাল বৈশাখী ঝড়, শিলাবৃষ্টি এসব হতে পারে। এমনটা হলে আমের উৎপাদন আরও কমে যাবে। সব মিলিয়ে বলা যায় আমরা যে আম উৎপাদনের আশা করেছিলাম তা এবার নাও হতে পারে।
এফএ/এমএস