‘রফাদফা’য় স্বস্তি মেলে আখাউড়া কাস্টমসে
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার বাসিন্দা মিঠু। গত মার্চ মাসের ১৯ তারিখ বাংলাদেশের এক পরিচিত জনের ধর্মীয় একটি অনুষ্ঠানে কাজে লাগাতে এক রুপি মূল্যে এক হাজার কাগজের থালা নিয়ে আসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে। কিন্তু এই থালার জন্যে তাকে কাস্টমসে আমদানি কর দিতে হবে উল্লেখ করে প্রথমে নাস্তানাবুদ করা হয়। এরপর চা-নাস্তার কথা বলে ১০০ টাকা চেয়ে নেওয়া হয়।
এরমধ্যে গত ৩ এপ্রিল দুপুরে ভারতীয় যাত্রী ঐশি সাহার ব্যাগ তল্লাশি করে একটি মদের বোতল পাওয়া যায়। দাবি করা হয় এক হাজার টাকা। ঐশি জানান, নিয়ম অনুসারে কোনো ধরনের কর ছাড়াই তিনি এটা আনতে পারেন। তখন ক্ষিপ্ত হয়ে কাস্টমসের এক সিপাহী মদের বোতলের ছিপি খুলে গ্লাসে ঢেলে ঐশিকে খেতে বলেন।
ভুক্তভোগী যাত্রী সঞ্জিত সাহা বলেন, আমার বোনকে জোর করে মদ খাইয়ে দিতে চেয়েছিল। আমাকেও খেতে বলেন। তারা এক হাজার টাকা দাবি করেছিল। আমি বাংলাদেশ সরকারের কাছে এই ঘটনার বিচার চাই।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরের চিত্র এটি। স্থলবন্দরের শুল্ক স্টেশনে (কাস্টমস) সাধারণ যাত্রীদের হয়রানি যেন নিত্যদিনের বিষয়। ‘লাগেজ স্ক্যানিং রুম’ এ সাধারণ যাত্রীদের ব্যাগ তল্লাশির নামে তাদেরকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়।
তবে ছাড় পেয়ে যান ‘রফাদফা’ যারা করেন। আগে থেকেই কিংবা বন্দরে এসে এই ‘রফাদফা’ করে একটি চক্র অবৈধভাবে লাখ লাখ টাকার পণ্য নিয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয়ভাবে তাদেরকে বলা হয় ‘লাগেজ পার্টি।’ ঈদকে সামনে রেখে ওই পার্টি প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার শাড়ি, থ্রিপিসসহ নানা ধরনের পোশাক ও কসমেটিসক যায়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব পণ্য পাচার হয়।
গত ১৬ মার্চ কাস্টমসের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পিটিয়ে লাগেজ পার্টি তাদের পণ্য নিয়ে যায়। তল্লাশি করার সময় জোর করে চলে গেলে তাদেরকে ধাওয়া করে কাস্টসমের লোকজন। কিছুদূর গিয়ে তাদেরকে আটক করা হলে মারধরের শিকার হন। এ ঘটনায় থানায় মামলা হলে পুলিশ হৃদয় নামে একজনকে গ্রেফতারও করে।
এ ঘটনায় আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ অবৈধভাবে পণ্য পরিবহনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মূলত রফাদফা না করেই চলে যেতে থাকায় ওই লাগেজ পার্টির পণ্য যেতে বাধা দেওয়া হয়। এর আগে চলে যাওয়া আরেকটি লাগেজ পার্টির পণ্য অনেক কম টাকায় ছেড়ে দেওয়া নিয়ে ওই পার্টির সঙ্গে তর্ক হয়ে মূলত এ হামলার ঘটনা ঘটে।
গত দুই সপ্তাহে একাধিক দিন আখাউড়া স্থলবন্দরে গিয়ে দেখা যায়, লাগেজ পার্টির চক্র এখনও সক্রিয়। বিশেষ করে ঈদকে সামনে রেখে চক্রটি ভারত থেকে পণ্য আনে। ওই চক্রের সঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশের লোকজন জড়িত। ভারতীয় লোকজন মূলত পণ্য পরিবহন করে। পণ্যের ক্রেতা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা। আর স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি পণ্য আনার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। বাংলাদেশের কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তারাই কথা বলেন।
একাধিক সূত্র জানায়, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ওপারে গিয়ে পণ্য কিনে রাখে। এরপর ভারতীয়দেরকে দিয়ে এসব পণ্য আনায়। একেকজন ছয়-সাতটি ব্যাগে করে পণ্য নিয়ে আসে। বহনকারী ওই সদস্যরা বেশিরভাগ সময় আখাউড়া-চট্টগ্রাম পথে চলাচলকারী অনঅনুমোদিত একটি বাস ব্যবহার করে পণ্য নিয়ে যায়। আবার অনেকে ট্রেনে করে ও অন্যভাবে সড়কপথে পণ্য নেয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রভাবশালীরা কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজের পাশাপাশি তাদেরকে যাওয়ার ক্ষেত্রেও সহযোগিতা করে।
এ বিষয়ে স্থলবন্দরের রাজস্ব কর্মকর্তা মো. আব্দুল কাইয়ুম তালুকদার বলেন, ‘যাত্রীরা খারাপ আচরণ করেছে। অনেক সময় যাত্রীরা ব্যাগেজের যে নিয়ম আছে সেটি মানতে চান না। এক্ষেত্রে তাদেরকে নির্ধারিত নিয়ম মেনে সরকারি কোষাগারে টাকা পরিশোধ করতে হয়। এটি বলার কারণে ১৬ মার্চ হামলার ঘটনা ঘটে বলে জানান তিনি।
এফএ/এমএস