আরিফের পথেই কি হাঁটছেন আনোয়ার?
• আরিফের দেখানো স্থানে হকারদের পুনর্বাসন
• অবৈধ পার্কিং উচ্ছেদে নেই নতুন পরিকল্পনা
• শুরুতেই খোঁড়াখুঁড়ি, দুর্ভোগ-ভোগান্তি
বছর দু’য়েক আগে সিলেট সিটি করপোরেশন ছিল মাত্র ২৬ দশমিক ৫০ বর্গকিলোমিটারের একটি নগরী। বর্তমানে আয়তন বেড়ে হয়েছে তিনগুণ, প্রায় ৮০ বর্গকিলোমিটার। ওয়ার্ড সংখ্যা বেড়ে ২৭ থেকে হয়েছে ৪২টি। জনসংখ্যা ১০ লাখ। একই সঙ্গে বেড়েছে হকারদের দাপট, অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ, যত্রতত্র পার্কিং, বছরজুড়ে সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি ও যানজট। সংকট-অব্যবস্থাপনায় রাজধানী ঢাকার মতো সিলেট নগরবাসীকেও প্রতিদিনই বাসায় ফিরে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়। অপরিকল্পিত নগরায়ণে যানজট-দুর্ভোগ নিয়ে জাগো নিউজের সিলেট জেলা প্রতিনিধি আহমেদ জামিলের ছয় পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে ষষ্ঠ ও শেষটি।
সিলেট নগরীর যানজটের প্রধান দুই কারণ হকার ও অবৈধ পার্কিং স্ট্যান্ড। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের চ্যালেঞ্জ ছিল সিলেট সিটি করপোরেশনের টানা দুবারের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর ওপর। দফায় দফায় উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে অবৈধ স্ট্যান্ড উচ্ছেদ করতে পারেননি। তবে হকারদের পুনর্বাসন করেছিলেন তিনি।
নগরীর লালদিঘির পাড়ে নগর ভবনের পেছনে অস্থায়ীভাবে এক হাজার ৭০ জন হকারকে বসার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন আরিফুল। কিন্তু এ উদ্যোগ সফল হয়নি। হকাররা নির্ধারিত স্থান ছেড়ে ফের রাস্তা ও ফুটপাতে চলে আসেন।
আরিফ অধ্যায়ের সমাপ্তির পর গত ৭ নভেম্বর গ্রিন-ক্লিন-স্মার্ট সিটি নির্মাণের অঙ্গীকার নিয়ে সিলেট নগর পিতার আসনে বসেন নতুন মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। দায়িত্বগ্রহণের তিন মাসেও হকার ও অবৈধ পার্কিং উচ্ছেদে নতুন কোনো পরিকল্পনা নিতে দেখা যায়নি তাকে। এমনকি কোনো অভিযানও পরিচালনা করা হয়নি। ফলে চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল হকারদের দৌরাত্ম্য।
বিষয়টি নিয়ে সর্বমহল থেকে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। এ পরিস্থিতিতে আরিফের দেখানো সেই লালদিঘিরপাড়েই হকারদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেন তিনি। গত ১০ মার্চ লালদিঘিরপাড় মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে হকারদের পুনর্বাসন করেন মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
তবে তার এ উদ্যোগও বিফলে যাওয়ার আশঙ্কা দেখছেন নগরবাসী। এরই মধ্যে সেখানে পর্যাপ্ত ক্রেতা নেই বলে জানিয়েছেন হকাররা। কাপড় ব্যবসায়ীরা দোকান খুলেই বসেননি। তাছাড়া সামনে ঈদুল ফিতর। এ অজুহাতে ফের হকাররা সড়ক দখল করতে পারেন। নগরীর অতীত ইতিহাসও বলছে, একবার সুযোগ পেয়ে সড়কে ফিরলে হকারদের আর নির্ধারিত জায়গায় ফেরানো যায় না।
নগরীর লালদিঘিরপাড়ে পুনর্বাসিত হওয়া সবজি বিক্রেতা সফির আলী বলেন, ‘এখানে যে প্রক্রিয়ায় সবাইকে একটি করে কোটা বরাদ্দ করা হয়েছে, তা আমাদের জন্য অনেক ভালো হয়েছে। তবে আগে সড়কে যেভাবে কয়েক দফায় চাঁদা দেওয়া হয়েছে সেভাবে এখানে চাঁদা দিতে বাধ্য করা হলে কেউ টিকবে না। কারণ এখানে বিক্রি কম। আগে বিক্রি বেশি থাকায় চাঁদা দিয়ে ব্যবসা ভালো হয়েছে।’
যেসব সড়কে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে, সেসব সড়কের দুই প্রান্তে প্রকল্পের নাম, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম, কাজের মেয়াদ ও প্রকল্প ব্যয় উল্লেখ করে সাইনবোর্ড সাঁটিয়ে রাখা উচিত। তখন মানুষ জানতে পারবে কবে শেষ হবে উন্নয়ন কাজ। তাছাড়া ভালো কাজ হলে মানুষ সেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে আরও বেশি মূল্যায়ন করবে। এছাড়া এটি তথ্য অধিকার আইনের একটি অংশও বটে। -ফারুক মাহমুদ চৌধুরী
পুনর্বাসিত হওয়া ভ্রাম্যমাণ কাপড়ের ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের বলা হয়েছে এ মার্কেটে ঢোকার জন্য রাস্তা নির্মাণ করে দেওয়া হবে। আমরা মেয়রের দিকে চেয়ে আছি। যদি রাস্তা করে দেওয়া না হয় তাহলে এখানে কোনো ব্যবসায়ী থাকতে চাইবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখনো সবজি বিক্রেতা ছাড়া হাতেগোনা কয়েকজন কাপড় ব্যবসায়ী দোকান খুলে রেখেছেন। বাকি সবাই অপেক্ষা করছেন। অনেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।’
নিজেদের উদ্যোগ বিফলে যেতে না দিতে প্রতিনিয়তই অভিযান পরিচালনা করছে সিলেট সিটি করপোরেশন। নগরীর বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের সড়ক থেকে উচ্ছেদ করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। অভিযানে মালামাল জব্দ করা ছাড়াও আদায় করা হচ্ছে জরিমানা।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘হকারদের বারবার উচ্ছেদ করা হয়। ফের তারা সড়কে ফিরে আসে। এর পেছনে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন কাজ করে। বর্তমান মেয়র যে উদ্যোগ নিয়েছেন, সেটি খুবই চমৎকার সিদ্ধান্ত। কিন্তু যারা হকারের পেছনে কাজ করে, হকারদের সঙ্গে যাদের আর্থিক সম্পর্ক রয়েছে এসব রাজনৈতিক দৃর্বৃত্তকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা না হলে হকাররা আবার সড়ক দখল করে ব্যবসা করবে।’
অতীতের মতো এবছরও সিলেট নগরীতে শুরু হয়েছে উন্নয়নের নামে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। একসঙ্গে নগরীর অন্তত ১২-১৫টি সড়কে যান চলাচল সীমিত আবার কোথাও বন্ধ রেখে চলছে উন্নয়ন কাজ। সিসিকের এমন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে শুধু যান চলাচলই ব্যাহত হচ্ছে না, মানুষের হাঁটাচলায়ও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। এতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে।
নগরবাসী বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে একই স্থান ও সড়কে বারবার খোঁড়াখুঁড়ি করতে হচ্ছে। এতে স্থায়ী সমাধান তো হচ্ছে না, উল্টো মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। সামনে রোজার মাসে মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে।
আরও পড়ুন
- ট্রাফিকে জনবল সংকট প্রকট, প্রক্সি দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ!
- গোল চত্বরের অপরিকল্পিত স্থাপনা ট্রাফিকের ‘বিষফোঁড়া’
- যানবাহনের চাপ অনুযায়ী প্রশস্ত নয় সড়ক, বাড়ছে জনভোগান্তি
- নগরীজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বৈধের তিনগুণ অবৈধ যানবাহন
সিসিক জানায়, ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত সিটি করপোরেশন এলাকায় ৩০০ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। তাছাড়া ৭০ কিলোমিটার ফুটপাত ও ৩ দশমিক ৬১ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এবছরও কিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে যার কাজ চলছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, চৌহাট্টা-রিকাবীবাজার, মদিনা মার্কেট-ওসমানী মেডিকেল রোডসহ বিভিন্ন সড়কে একলেন বন্ধ রেখে উন্নয়ন কাজ চলছে। আম্বরখানা-চৌহাট্টা সড়ক পুরোপুরি বন্ধ রেখে কাজ চলছে। একসঙ্গে নগরীর ব্যস্ততম একাধিক স্থানে রাস্তার একাংশ বন্ধ করে খোঁড়াখুঁড়ির কারণে দুপুর থেকেই সৃষ্টি হয় যানজট। বিকেলে সেটা গড়ায় অসহনীয় পর্যায়ে।
উন্নয়ন কাজকে অনেকে ভালো দৃষ্টিতে দেখলেও সিসিক ও সড়ক-জনপথের গাফিলতি রয়েছে বলে দাবি করছেন। কোন সড়কে উন্নয়ন কাজ চলছে, বিকল্প পথ কোনটি- এসব তথ্য না জানার কারণে ভোগান্তি বেড়েছে আরও বহুগুণ। গ্রামাঞ্চল থেকে আসা লোকজন এসব তথ্য না জানার কারণে বেশি ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়। বিশেষ করে সিলেটের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা রোগীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। এ পরিস্থিতিতে উন্নয়ন কাজের সঠিক তথ্য বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারের দাবি জানিয়েছে নগরবাসী।
নগরীর খাসদবির এলাকার বাসিন্দা আব্দুল গনি বলেন, ‘আম্বরখানা-চৌহাট্টা সড়ক বন্ধ করে কাজ চলছে তা জানা ছিল না। জিন্দাবাজার যাওয়ার উদ্দেশ্যে রাস্তায় বেরিয়ে দেখি এ সড়ক বন্ধ। বাধ্য হয়ে মাকে নিয়ে অনেক সড়ক ঘুরে জিন্দাবাজার যেতে হয়েছে। এ সড়ক বন্ধ করে কাজ চলছে তা আগে জানলে বিকল্প পথেই চলে যেতাম।’
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, যেসব সড়কে চলাচল বন্ধ করে উন্নয়ন কাজ চলছে সেসব তথ্য সিটি করপোরেশন কিংবা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের পক্ষ থেকে প্রচার করতে হবে। যাতে মানুষকে অযথা ঘুরতে না হয়। বিশেষ করে গ্রামের মানুষ শহরে এলে যাতে ভোগান্তি পোহাতে না হয়।’
আমরা প্রত্যেকটি কাজ পরিকল্পিতভাবে করতে চাই। যাদের হকার বলা হচ্ছে তারা হচ্ছে আমাদের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। আমরা তাদের লাঠিপেটা করবো না। তাদের পুনর্বাসন করা হয়েছে।- মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী
তিনি আরও বলেন, ‘যেসব সড়কে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে, সেসব সড়কের দুই প্রান্তে প্রকল্পের নাম, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম, কাজের মেয়াদ ও প্রকল্প ব্যয় উল্লেখ করে সাইনবোর্ড সাঁটিয়ে রাখা উচিত। তখন মানুষ জানতে পারবে কবে শেষ হবে উন্নয়ন কাজ। তাছাড়া ভালো কাজ হলে মানুষ সেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে আরও বেশি মূল্যায়ন করবে। এছাড়া এটি তথ্য অধিকার আইনের একটি অংশও বটে।’
নগরীর আরেক বিড়ম্বনা অবৈধ পার্কিং স্ট্যান্ড। আবাসিক এলাকা থেকে শুরু করে হাসপাতালকেন্দ্রিক স্ট্যান্ড রয়েছে অটোরিকশার। এসব কোনোটিরই অনুমোদন নেই। এসব স্ট্যান্ডে থাকা অটোরিকশা যানজট সৃষ্টির অন্যতম কারণ। হাসপাতালকেন্দ্রিক স্ট্যান্ডগুলোতে মানুষকে জিম্মি করে ভাড়া আদায় করছেন চালকরা। এতে যানজটের দুর্ভোগ ছাড়াও ভাড়া নিয়ে অতিষ্ঠ সাধারণ যাত্রীরা।
চৌহাট্টা থেকে রিকাবীবাজার ও আম্বরখানামুখী দুটি সড়কে অন্তত তিনশ থেকে চারশ মাইক্রোবাস ও অন্য গাড়ি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো। আম্বরখানামুখী সড়ক থেকে বেশিরভাগ গাড়ি ভাড়ায় জেলা শহর সুনামগঞ্জ ছাড়াও ছাতক ও দিরাই উপজেলায় যায়। চৌহাট্টা-রিকাবীবাজার সড়ক থেকে সিলেটের বিভিন্ন উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাড়ায় যায় এসব গাড়ি।
এ প্রসঙ্গে সিলেট জেলা পরিবহন শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি মো. দিলু মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘যত্রতত্র পার্কিং স্ট্যান্ড নিয়ে আমরাও অতিষ্ঠ। রাস্তায় রাস্তায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা স্ট্যান্ড। বিভিন্ন মহল থেকে বিষয়টি আমাদের অবগত করা হয়। এ ব্যাপারে মেয়র বলেছেন সবাইকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আসতে হবে। আগামী মাসে এ নিয়ে বৈঠক হবে। বৈঠকে পরিবহন শ্রমিকরা কোথায় পার্কিং স্ট্যান্ড করে বসবেন সেটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
সব পক্ষ দখলের বিষয়টি জানলেও কেউ কোনো কড়া পদক্ষেপ কিংবা সমাধান দিতে পারছেন না। আরিফুলও পারেননি, আনোয়ারুজ্জামানও অনেকটা সেই পথেই হাঁটছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা বিশ্বজিত দেব জাগো নিউজকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশন আইনের সঙ্গে যেগুলো সাংঘর্ষিক, যে আইনগুলো মানা উচিত সেগুলো না মেনে যারা জনগণের চলার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে তাদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সড়ক থেকে অপসারণ করা হচ্ছে।’
একসঙ্গে বিভিন্ন সড়কে চলমান উন্নয়ন কাজ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সার্বিক বিষয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা প্রত্যেকটি কাজ পরিকল্পিতভাবে করতে চাই। যাদের হকার বলা হচ্ছে তারা হচ্ছে আমাদের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। আমরা তাদের লাঠিপেটা করবো না। তাদের পুনর্বাসন করা হয়েছে।’
জেএএইচ/এএসএ/এএসএম