ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

ট্রাফিকে জনবল সংকট প্রকট, প্রক্সি দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ!

আহমেদ জামিল | সিলেট | প্রকাশিত: ০৮:২৭ এএম, ২০ মার্চ ২০২৪

বছর দু’য়েক আগে সিলেট সিটি করপোরেশন ছিল মাত্র ২৬ দশমিক ৫০ বর্গকিলোমিটারের একটি নগরী। বর্তমানে আয়তন বেড়ে হয়েছে তিনগুণ, প্রায় ৮০ বর্গকিলোমিটার। ওয়ার্ড সংখ্যা বেড়ে ২৭ থেকে হয়েছে ৪২টি। জনসংখ্যা ১০ লাখ। একই সঙ্গে বেড়েছে হকারদের দাপট, অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ, যত্রতত্র পার্কিং, বছরজুড়ে সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি ও যানজট। সংকট-অব্যবস্থাপনায় রাজধানী ঢাকার মতো সিলেট নগরবাসীকেও প্রতিদিনই বাসায় ফিরে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়। অপরিকল্পিত নগরায়ণে যানজট-দুর্ভোগ নিয়ে জাগো নিউজের সিলেট জেলা প্রতিনিধি আহমেদ জামিলের ছয় পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে পঞ্চমটি।

সিলেট নগরীতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে যানজট। ট্রাফিকে জনবল সংকট প্রকট। সড়কে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হলেও সক্ষমতা বাড়ছে না পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের। ছোট্ট এ নগরীতে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে ট্রাফিক সদস্যদের। কোথাও কোথাও সড়কে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সাধারণ মানুষ অবতীর্ণ হচ্ছেন ট্রাফিকের ভূমিকায়।

সড়ক স্বাভাবিক রাখতে গিয়ে অবৈধ যানবাহন ও ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ঠিকমতো ব্যবস্থা নিতেও পারছে না তারা। রয়েছে পরিবহন শ্রমিকদের প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের দাপট-হুমকি। এসব কারণে কমছে মামলার সংখ্যাও। ফলে বাড়ছে যান চালকদের দৌরাত্ম্য।

তবে পুলিশ বলছে, আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে মামলা যথারীতি হচ্ছে। মাঝে মধ্যে যানজট এড়াতে অভিযান কম হয়। তারপরও যারা আইন মানছেন না তাদের মামলা দেওয়া হচ্ছে।

যানজট, ট্রাফিক, দেশজুড়ে স্পেশাল, সিলেট, শ্রমিকট্রাফিকে জনবল সংকট প্রকট, প্রক্সি দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ!

৫১৮ দশমিক ৪৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) মাত্র ৪২টি পয়েন্টে কাজ করেন ট্রাফিক সদস্যরা। জনবল সংকটের কারণে এই ৪২টি পয়েন্ট সামলাতেও হিমশিম খেতে হয় ট্রাফিক সদস্যদের। যে কারণে অনেক সময় সাধারণ মানুষকেও সড়কে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। তবুও জনবল সংকটের সমস্যা সমাধান করা হচ্ছে না।

এসএমপির ট্রাফিক বিভাগের তথ্যমতে, পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ এ বিভাগে মঞ্জুরি করা পদ ২৮৮টি। এর মধ্যে কর্মরত ২৫২ জন। কাগজে-কলমে কর্মরত পুলিশের সংখ্যা ২৫২ জন থাকলেও ছুটি ও বিভিন্ন কারণে অনুপস্থিতির কারণে প্রতিদিন উপস্থিত থাকেন ২০০ জনের মতো।

আমাদের জনবল কম। সব জায়গায় চাইলেই ট্রাফিক সদস্য দেওয়া সম্ভব নয়। তবে অধিক গুরুত্বপূর্ণ সবকটি পয়েন্টেই ট্রাফিক সদস্যরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেন।- এসএমপির উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান

ট্রাফিক বিভাগ আরও জানায়, নগরীর ৪২টি পয়েন্টে ন্যূনতম তিনজন করে দায়িত্ব বণ্টন করা হলে এক শিফটে ১২৬ জন ট্রাফিক সদস্য প্রয়োজন। দুই শিফটে ২৫২ জন। এছাড়া রাতে নগরীর বিভিন্ন স্থানে গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে অভিযানে যেতে হয় ট্রাফিক সদস্যদেরও। এছাড়া বিভিন্ন বিশেষ দিবস ও খেলাধুলার কারণে শিফটের বাইরে অতিরিক্ত ট্রাফিক সদস্যকে কাজ করতে হয়। এর বাইরে রয়েছে অফিস ডিউটি। প্রতিদিন অফিসেও শত শত মানুষকে বিভিন্ন ধরনের সেবা দিতে হয়। সব মিলিয়ে প্রতিদিন ৩৫০-৪০০ জনবল প্রয়োজন। সে তুলনায় জনবল নেই ট্রাফিক বিভাগের।

আরও পড়ুন

জনবল সংকটের কারণে কমছে মামলার সংখ্যা। তবে সূত্র বলছে ‘ট্রাফিক সংকট’ ছাড়াও পরিবহন চালকদের সঙ্গে পুলিশের ‘আর্থিক লেনদেনের’ কারণে মামলা কম হচ্ছে। ট্রাফিক বিভাগের বিগত তিন বছরের মামলার পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায় গত বছর (২০২৩ সাল) মামলা হয়েছে ২২ হাজার ৬৫৩টি। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে মামলা হয়েছে ২ হাজার ৮২টি, ফেব্রুয়ারিতে ২ হাজার ৮৫৭টি, মার্চে ২ হাজার ১৪৮টি, এপ্রিলে ১ হাজার ১১১টি, মে মাসে ২ হাজার ৪০৮টি, জুনে ১ হাজার ২৭৯টি, জুলাইয়ে ২ হাজার ৫৩৪টি, আগস্টে ২ হাজার ৩২১টি, সেপ্টেম্বরে ২ হাজার ২৬৪টি, অক্টোবরে ১ হাজার ৮৩২টি, নভেম্বরে ৪১৫টি ও ডিসেম্বরে ১ হাজার ৪০২টি। সবমিলিয়ে গত বছর ২২ হাজার ৬৫৩টি মামলায় জরিমানা থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছে ৬ কোটি ৯৫ লাখ ১৪ হাজার ২১৫ টাকা।

যানজট, ট্রাফিক, দেশজুড়ে স্পেশাল, সিলেট, শ্রমিকট্রাফিকে জনবল সংকট প্রকট, প্রক্সি দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ!

এর আগের বছর ২০২২ সালে প্রায় ২৭ হাজার মামলায় সরকারের আয় হয় সাড়ে ৮ কোটি টাকার বেশি। ২০২১ সালে মামলা হয় সাড়ে ২৭ হাজারের বেশি। এতে জরিমানা থেকে সরকারের আয় হয় প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক বলেন, সিলেটে যত অবৈধ অটোরিকশা রয়েছে বেশিরভাগই পুলিশ ‘ম্যানেজ’ করে চলে। যখন অভিযান শুরু হয় তখন পুলিশই বলে দেয় সাবধান থাকতে। তা না হলে ট্রাফিক পুলিশের চোখের সামনে কীভাবে এত অবৈধ যানবাহন চলাচল করে।

নগরীর সুবিদবাজার এলাকার এক অটোরিকশাচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মামলা দেওয়ার চেয়ে ট্রাফিক পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করা ভালো। কারণ একটা মামলা দেওয়া হলে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। এজন্য মামলা দেওয়ার আগে সব চালকই চায় পুলিশের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করতে।

কাজী খালিক নামে এক মোটরসাইকেল আরোহী বলেন, মামলা দিতে পুলিশের টার্গেট থাকে। যখন টার্গেট পূরণ করতে পারে না, তখন সড়কে নেমে গণহারে মামলা দেয় পুলিশ। তখন কাগজপত্র থাকলেও কোনো না কোনো ত্রুটি খুঁজে বের করে।

যানজট, ট্রাফিক, দেশজুড়ে স্পেশাল, সিলেট, শ্রমিকট্রাফিকে জনবল সংকট প্রকট, প্রক্সি দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ!

এসব কথা উড়িয়ে দিয়েছেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘মামলা দিতে কোনো টার্গেট নেই। আমরা প্রতিনিয়তই অভিযান পরিচালনা করি। প্রতিদিনই মামলা হচ্ছে। গত বছর অবরোধ-ধর্মঘটের কারণে যানবাহন চলাচল কম ছিল। যার কারণে মামলা কিছুটা কম হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘সড়ক সচল রাখতে অনেক সময় মামলা দেওয়া যায় না। অভিযান পরিচালনার সময় সিগন্যাল দিলে সড়কের এক লেন ‘পেট মোটা’ হয়ে যায়। অর্থাৎ পেছন থেকে গাড়ি এসে ডান পাশে জটলা বাঁধে। সবাই আগে যেতে চায়। লাইনে দাঁড়াতে চায় না। যাদের কাগজপত্র সঠিক না তাদের সবাইকে পুলিশ মামলা দিতে চায়। কিন্তু যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে মামলা দেওয়া থেকে সরে আসতে হচ্ছে।’

এজন্য চালকরা সম্পূর্ণ দায়ী উল্লেখ করে ট্রাফিকের ডিসি বলেন, ‘চালকরা নিয়ম না মানায় পুরো সিস্টেমটাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। এর একমাত্র সমাধান হলো চালকদের সচেতন হওয়া। শহরে এই মুহূর্তে সিএনজি অটোরিকশার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এগুলোর বেশিরভাগই অনিবন্ধিত। সিএনজি অটোরিকশাগুলো একটা নিয়মের মধ্যে আনতে আমরা কাজ করছি।’

যানজট, ট্রাফিক, দেশজুড়ে স্পেশাল, সিলেট, শ্রমিকট্রাফিকে জনবল সংকট প্রকট, প্রক্সি দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ!

তিনি বলেন, যানবাহন অনুমোদনের সময় উল্লেখ থাকে কতজন যাত্রী বহন করবে। কিন্তু পরবর্তীসময়ে মালিক-চালকরা এটি পরিবর্তন করে ইচ্ছামতো যাত্রী বহন করে। সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও বাসে এটি বেশি হয়। অটোরিকশায় চালকসহ চারজনের রোড পারমিট থাকলে তারা পাঁচজন যাত্রী নিয়ে চলাচল করে। এটা তাদের পারমিটে নেই। এজন্য প্রতিদিনই মামলা হচ্ছে। আমরা কাজ করছি কিন্তু উল্টো আমাদের ওপর অভিযোগ তুলছে আমরা অযথা তাদের হয়রানি করছি।’

ট্রাফিকের ডিসি মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘সিএনজিচালিত অটোরিকশায় গ্রিল লাগানোর নিদের্শনা বাস্তবায়নে কাজ করছে এমপিজিটিসি। এর আগে একবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। এবার এটা বাস্তবায়নে জোরালো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া সিলেট নগরীর সড়কগুলো কীভাবে একটা সুন্দর শৃঙ্খলায় আনা যায় সেটি নিয়ে সিটি করপোরেশনের মেয়রকে আমরা প্রস্তাবনা দিয়েছি। তিনি কী উদ্যোগ নিচ্ছেন সেজন্য আমরা অপেক্ষা করছি।’

যানজট, ট্রাফিক, দেশজুড়ে স্পেশাল, সিলেট, শ্রমিকট্রাফিকে জনবল সংকট প্রকট, প্রক্সি দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ!

ট্রাফিক সংকটের কারণে অনেক সময় যানজট এড়াতে কাজ করেন সাধারণ মানুষও। বিশেষ করে নগরীর ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রোড, কাজলশাহ, সুবিদবাজার, পাঠানটুলা, মদিনা মার্কেট, উপশহর রাস্তার মুখ ও শিবগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় তীব্র যানজটের সময় স্থানীয়দের পুলিশের সঙ্গে কাজ করতে দেখা যায়। অনেক সময় পরিবহন শ্রমিকরাও এসে শামিল হন এ কাজে।

যানজট, ট্রাফিক, দেশজুড়ে স্পেশাল, সিলেট, শ্রমিকট্রাফিকে জনবল সংকট প্রকট, প্রক্সি দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ!

কাজলশাহ এলাকার ফার্মেসি ব্যবসায়ী আখলাক উদ্দিন বলেন, ‘প্রতিদিনই এ সড়কে যানজট লেগে থাকে। বিশেষ করে সন্ধ্যা নামলে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এখানে ট্রাফিক পুলিশ না থাকায় অনেক সময় ব্যবসায়ী ও স্থানীয়রা এগিয়ে আসেন।’

এ বিষয়ে এসএমপির উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের জনবল কম। সব জায়গায় চাইলেই ট্রাফিক সদস্য দেওয়া সম্ভব নয়। তবে অধিক গুরুত্বপূর্ণ সবকটি পয়েন্টেই আমাদের ট্রাফিক সদস্যরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেন।’

জেএএইচ/এএসএ/জেআইএম