মেহেরপুর
প্রণোদনার বীজ নিয়ে বিপাকে পেঁয়াজ চাষিরা
সরকারি কৃষি প্রণোদনার পেঁয়াজের বীজ ব্যবহার করে লোকসানে পড়েছেন মেহেরপুরের পেঁয়াজ চাষিরা।
আবাদের পর পেঁয়াজের গুটির বদলে মিলছে শুধুই শেকড়। অমৌসুমের বীজ জেনেও কোনো অদৃশ্য কারণে চাষীদেরকে দিয়ে আবাদ করানো হলো সে প্রশ্নের উত্তরে নির্বিকার কৃষি বিভাগ।
জেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, মেহেরপুরের তিনটি উপজেলায় ২২২০ কেজি পেঁয়াজের বীজ প্রণোদনা হিসেবে দেওয়া দেওয়া হয় যার মধ্যে ৫২০ কেজি বীজ শীতকালীন হিসেবে দেওয়া হয় ৭০০ জন কৃষকের মাঝে। মেহেরপুর জেলায় নাসিক রেড ইন ৫৩ জাতের পেঁয়াজের বীজটি মেহেরপুর সদর উপজেলায় ১৬০ জন, গাংনী উপজেলায় ১৫০ জন ও মুজিবনগর উপজেলায় ২১০ জন কৃষকের মাঝে বিতরণ করা হয়।
চাষিরা জানান, জেলার ৫২০ চাষিকে পেঁয়াজ আবাদ বৃদ্ধির জন্য সরকারি প্রণোদনার আওতায় বীজ ও সার সহায়তা দেয় কৃষি অফিস। ভারত থেকে আমদানীকৃত নাসিক রেড এন ৫৩ জাতের পেঁয়াজের বীজ দেওয়া হয় জেলার তিন উপজেলার কৃষকদের মাঝে। সরকারি এ বীজে ভরসা করেই জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করেছিলেন চাষীরা। কেউ বীজ বপণ করে আবার কেউ চারা তৈরি করে পেঁয়াজ চারা রোপণ করেছিলেন স্ব স্ব জমিতে। কৃষি বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী পেঁয়াজের জমিতে পরিচর্যা করেছেন কৃষকরা।
কিন্তু রোপণের তিন মাসের মধ্যে পেঁয়াজ পরিপক্ক হওয়ার কথা থাকলেও এখন মিলছে শুধুই শেকড়। নভেম্বর মাসে ক্ষেতে পেঁয়াজ চারা রোপণ করলেও এখন পর্যন্ত মিলছে না পেঁয়াজের গুটি। ক্ষেতগুলোতে পুষ্ট পেঁয়াজ গাছ থাকলেও তার গোড়ায় কোনো পেঁয়াজ পাচ্ছেন না চাষীরা। গুটি বাঁধবে এ আশায় চাষিরা দিনের পর দিন অপেক্ষা করে প্রয়োজনীয় সার কীটনাশকে ব্যয় করে যাচ্ছেন। কিন্তু গাছ তুললে গোড়াতে শুধু শেকড় ছাড়া কোনো গুটির দেখা মিলছে না। কৃষি অফিসের কাছ থেকে কোনো সদুত্তোর না পেয়ে পেঁয়াজের আশা ছেড়ে দিয়েছেন অনেক কৃষক।
তারা জানান, পেঁয়াজ চাষে সফল হলে ৭০০ বিঘা জমি থেকে প্রায় ১৬ কোটি টাকার পেঁয়াজের উৎপাদন হতো।
সরেজমিনে গাংনী উপজেলার সাহারবাটি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামটিতে ৭-৮ জন কৃষক উপজেলা কৃষি অফিস থেকে গেলো বছরের অক্টোবরে নিয়েছিলেন সরকারি প্রণোদনার নাসিক রেড এন-৫৩ জাতের পেঁয়াজের বীজ। পেঁয়াজ উত্তোলনের সময় পেরিয়ে গেলেও এখনও হয়নি পেঁয়াজের গুটি।
এ বিষয়ে কৃষক শরিফুল ইসলাম জানান, আমার রান্দা ভাতে ছাই পড়েছে। সরকারি বীজ নিয়ে ভালো জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করে বিপদে পড়েছি। অন্য সকল জমিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে কিন্তু যারা সরকারি এই বীজ নিয়ে পেঁয়াজ আবাদ করেছেন শুধু তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। লিজ খরচসহ প্রতি বিঘা পেঁয়াজ আবাদে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকার ওপরে খরচ হয়েছে।
কৃষক গোলাম মোস্তফা জাগো নিউজকে জানান, এক বিঘা জমিতে সরকারি বীজ নিয়ে পেঁয়াজের আবাদ করেছিলেন তিনি। ইতিমধ্যে প্রায় ৪০ হাজার টাকা খরচ করেছেন এ আবাদের পেছনে। পেঁয়াজের উচ্চ মূল্যের ফলে বিঘা প্রতি জমি তিন লাখ টাকার পর্যন্ত পেঁয়াজ বিক্রি করছেন কৃষকরা। কিন্তু নিজ জমিতে পেঁয়াজের বদলে পাওয়া যাচ্ছে শুধুই পেঁয়াজ গাছের শিকড়। পরবর্তী আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি।
কাকন আলী নামে আরেক কৃষক জানান, শুধু গাংনী উপজেলা নয় জেলার সকল কৃষকের একই অবস্থা। সরকারি বীজ তাই ভাল ফলনের আশায় পেঁয়াজ আবাদ করেছিলেন তারা। কিন্তু তাদের জানা ছিল না গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের বীজে শীতকালে গুটি হবে না। ফলে পুরো আবাদের লোকসানে পড়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন।
এ জাতের বীজটি সম্পর্কে বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আশরাফুল আলম জানান, ইতিপূর্বে নাসিক এন-৫৩ জাতটি পরীক্ষামূলকভাবে নাটোরে চাষ করানো হয়েছিল। বাস্তবিকভাবে দেখা যায় যারা আগাম লাগিয়েছিল তাদের ফলন ভালো হয়েছিল। কিন্তু দেরি করার ফলে অনেকেরই ফলন কম দেখা যায়। সার প্রয়োগের তারতম্যের কারণেও এমনটি হতে পারে বলে ধারণা করা হয়েছিল তখন। তবে সাধারণত জুন জুলাইয়ের সময়ে এ জাতটি আবাদ করার মোক্ষম সময় বলে জানান এ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারত থেকে নাসিক গ্রেড ইন ৫৩ জাতের পেঁয়াজটি আমদানিকারক এক ব্যবসায়ী জানান, গত বছর দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৩৪.৫ টন এ জাতের পেঁয়াজের বীজ খরিদ করে বিএডিসি। সময়ক্ষেপণ করে দেরিতে জমিতে চাষাবাদ শুরু করার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।
সরকারি বীজ উৎপাদন প্রতিষ্ঠান বিএডিসি ভারত থেকে আমদানী করে কৃষি অফিসে সরবরাহ করে নাসিক রেড এন ৫৩ জাতের পেঁয়াজের বীজ। তবে কেন অমৌসূমের বীজ জেনেও চাষীদের মাঝে তা বিতরণ করা হলে সে বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ কৃষি কর্মকর্তা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিজয় কৃষ্ণ হালদার জানান, বিএডিসি থেকে বীজ পেয়ে কৃষকদের মাঝে সরবরাহ করার কাজটি তাদের ছিল। সঠিকভাবে পরিচর্যা, সার প্রয়োগ ও চাষাবাদের সকল পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
তবে ভিন্ন মৌসুমের বীজ কেনো বিতরণ করা হলো এ প্রশ্ন করা হলে বিষয়টি নিয়ে কোনো সদুত্তোর দিতে পারেননি তিনি এ কর্মকর্তা।
আসিফ ইকবাল/এনআইবি/এএসএম