পড়াশোনা না করতে স্ট্যাম্পে সই করা নিপা বিশ্বাস আজ সফল শিক্ষক
পরার জন্য ছিল একটি মাত্র শাড়ি, সেটাও ছেঁড়া। নিজেই সেলাই করে সেই শাড়ি পরে কলেজে যেতেন নিপা বিশ্বাস। কখনো বৃষ্টিতে শাড়ি ভিজে গেলে তা নিয়েই ক্লাস করতেন। কখনো খেয়ে, কখনো না খেয়ে থাকতেন। অন্যের বাড়িতে লজিং থেকে পড়ালেখা করেছেন। শত কষ্টের পর আজ তিনি একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। একমাত্র মেয়েকেও শিক্ষিত করেছেন।
নানা প্রতিকূলতা, অভাব আর প্রত্যন্ত গ্রামে থেকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করায় ২০২৩ সালে পেয়েছেন জয়িতা পুরস্কার। নিজের কষ্টের কথাগুলো বলতে গিয়ে বার বার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন নিপা বিশ্বাস।
এ সময় নিপা বিশ্বাস কেঁদে কেঁদে বলেন, এখন আমি প্রতিষ্ঠিত। এবার জয়িতা পুরস্কারও পেয়েছি। তাই সবার কাছে এখন আমার একটা মূল্য আছে। কিন্তু একটা সময় গেছে, কেউ আমার খোঁজ নেয়নি। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ঢাকাতে সামান্য বেতনে চাকরি করেছি। তখন দিনের পর দিন মেয়েকে নিয়ে একা থেকেছি। ভাই, বোন এমনকি কোনো আত্মীয় স্বজনও একটি বারের জন্য খোঁজ নেয়নি। যখন দেখতাম আমার অন্য সহকর্মীর স্বজনরা খোঁজ খবর নিচ্ছেন, তখন আমি সবার আড়ালে কাঁদতাম। মনে হতো কেউ যদি আমার একটু খোঁজ নিতো। কারো কাছ থেকে একটু সহযোগিতাতো দূরের কথা একটু সহানুভূতিও পাইনি।
জানা যায়, মাদারীপুর ডাসার উপজেলার পূর্ব নবগ্রামের জামিনি কান্তি বিশ্বাস ও লক্ষ্মী রাণী বিশ্বাসের মেয়ে নিপা বিশ্বাস (৪৭)। জন্মের পর থেকেই অভাবের মধ্যে বড় হতে হয়েছে তাকে। দুই ভাই ও তিন বোনের সংসারে অভাব লেগেই থাকতো। বাবা অন্যের জমিতে চাষ করে দিনমজুর হিসেবে যে টাকা পেতেন তা দিয়ে ঠিকমতো খাবার যোগাড় করাই অসম্ভব ছিল। এই অভাবের মধ্যেই নিপা বিশ্বাস পড়াশুনা করেছেন।
১৯৯৪ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার সময় পরীক্ষাকেন্দ্রে বসেই পরিচয় হয় মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার সিডিখান ইউনিয়নের ঢাকীকান্দি গ্রামের শংকর কুমার বৈদ্যের সঙ্গে। তিনিও এসএসসি পরীক্ষা দিতে এসেছিলেন। এরপর দুজনের মধ্যে প্রেমের সর্ম্পক গড়ে ওঠে। পরিবারের মতামতে আনুষ্ঠিকভাবে বিয়ে হয়। কিন্তু শংকর বিয়ের দেড় মাস না যেতেই নিপাকে কিছু জানিয়ে মালয়েশিয়া চলে যান। বিদেশে গিয়ে নিপার আর কোনো খোঁজ খবর নেননি তিনি। এমনকি কোনো টাকা পয়সাও দিতেন না। বাধ্য হয়ে নিপাকে ফিরে আসতে হয় বাবার বাড়িতে।
মা লক্ষ্মী রাণী জমানো টাকা ও ধান বিক্রি করে কিছু টাকা যোগাড় করে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন নিপাকে। অন্য ছাত্রদের পড়িয়ে কিছু টাকা হাতে পেতেন, তা দিয়েই নিজের পড়াশুনার খরচ যোগাড় করতেন। অন্যের বাড়িতে লজিংও থেকেছেন। শুধুমাত্র একটি শাড়ি ছিল নিপার। তাও অনেক জায়গায় ছেঁড়া। নিজের হাতে সেলাই করে, সেই শাড়ি পরে কলেজে যেতেন। ধোয়ার পর না শুকালে সেই ভেজা শাড়ি পরেই কলেজে যেতে হতো নিপাকে। প্রায় দিন না খেয়ে থাকতো হতো। কখনও শুধু লবণ দিয়েও ভাত খেয়েছেন। টাকার জন্য বই কিনতে পারতেন না। বন্ধুদের বই চেয়ে বা কখনও কখনও পুরোনো বই সংগ্রহ করে পড়তেন। খাতা কিনতে পারতে না বলে পড়া মুখস্ত করতেন। তবুও তার কষ্টের কথা সম্মানের ভয়ে কাউকে বলতেন না। এমনকি কারো কাছে হাত পাততেন না। তার শুধু একটাই লক্ষ্য ছিল পড়াশুনা করে নিজ পায়ে দাঁড়াবেন। তাহলে তার আর কোনো কষ্ট থাকবে না। এভাবেই নানা কষ্ট করে এইচএসসি পাস করেন তিনি।
এরপর সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে বিএ ভর্তি হন। বিএ’র ফরম ফিলাপের সময় কোনোভাবেই টাকা যোগাড় করতে পারছিলেন না। তখন তিনি ভেবেছিলেন আর হয়তো তার পড়াশুনা হবে না। ওই সময় নিপার চেষ্টা দেখে এগিয়ে আসেন কলেজের শিক্ষক আমজাদ আলী সুমন। তিনি ১১০০ টাকা দেন। সেই টাকা দিয়ে নিপা বিএ’র ফরম ফিলাপ করেন। এরপর বরিশালের বিএম কলেজ থেকে ইতিহাসে মাস্টার্স ও ঢাকায় লাইব্রেরি সাইন্সে ডিপ্লোমা পাস করেন।
এরমধ্যে বিয়ের সাড়ে চার বছর পর নিপার স্বামী শংকর দেশে আসেন। এরপর তিন মাস থেকে আবার মালয়েশিয়া চলে যান। ওই সময় দেশে এসে নিপাকে পড়াশুনা করতে বাধা দেন তিনি। এমনকি স্ট্যাম্পে সই নেন নিপার, সেখানে লেখা থাকে নিপা আর পড়াশুনা করবে না। তবুও নিপা দমে যাননি। সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছেন তিনি। এরপর আবার দশ মাস পর দেশে আসেন শংকর।
পড়াশুনা করা অবস্থায় জন্ম নেয় মেয়ে মনিমুক্তা। এরপর আবার তিনি গর্ভবতী হন। কিন্তু অভাবের কারণে প্রায় সময় না খেয়ে থাকতে হয়েছে। তাই অপুষ্ট এক ছেলে সন্তান জন্ম হয়। তিন মাস বেঁচে ছিল সেই সন্তান। এভাবে তাকে প্রতিনিয়তই যুদ্ধ করতে হয়েছে।
স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্রে জানা, ২০০২ সালের ২৯ আগস্ট ব্রেইন স্টোক করে মারা যান নিপার স্বামী শংকর বৈদ্য। সনাতন ধর্মে বিধবা নারীদের মানতে হয় নানা নিয়ম। তাই তার শুরু হয় নতুন যুদ্ধ। শ্বশুরবাড়িতে তার আর স্থান হয় না। তখন স্বামীর সম্পত্তি পাওয়ার জন্য আদালতে মামলা করেন। প্রায় চার বছর মামলা শেষে স্বামীর সম্পত্তির অংশ পান তিনি।
২০০৬ সালে সেই সম্পত্তি (জমি) বিক্রি করে দেড় লাখ টাকা পান। সেই টাকা নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি আসার পথে কালকিনির ভুরঘাটা এলাকায় আসলে একদল মুখোশধারী লোক অস্ত্র ঠেকিয়ে সব টাকা নিয়ে যান। ওই টাকা দিয়ে তারা নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখলেও চোখের পলকে সব শেষ হয়ে যায়।
এরপর প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২ হাজার ৫০০ টাকা বেতনে চাকরি হয় নিপার। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে চলে যান সেখানে। এরপর ২০১১ সালে বরিশালের গৌরনদী এলাকার চাঁদশদী ঈশ্বর চন্দ্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। চাকরির প্রথম তিন বছর কোনো বেতন পাননি তিনি। সেই সময়েও স্কুলের পাশে একজনের বাড়িতে মেয়েকে নিয়ে লজিং থাকতেন। তখনও মেয়েসহ নিজে প্রায় সময় না খেয়ে, খুব কষ্ট করে দিন কাটাতে হয়েছে। মেয়েকে ভালো কিছু কিনে দিতে পারতেন না।
মেয়ে মনিমুক্তাকেও (২৪) বহু কষ্ট করে পড়াশুনা করতে হয়েছে। মনিমুক্তা এইচএসসি পাস করার পর বিএসসি নার্সিং পাস করেছেন। বর্তমানে প্রাইভেট একটি ক্লিনিকে নার্স হিসেবে চাকরি করছেন তিনি।
নিপা বিশ্বাস বলেন, অভাব আর পড়াশুনার জন্য প্রতিনিয়তই আমাকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হলো শুধুমাত্র ঠিকমতো খেতে না পারার জন্য অপুষ্ট এক ছেলে সন্তানের জন্ম দিতে হয়েছিল। সেই ছেলে মাত্র তিন মাস বেঁচে ছিল। একজন মায়ের কাছে এর চেয়ে দুঃখের আর কী হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, হয়তো লেখাপড়ার জন্য জীবনে যে যুদ্ধ করেছি, তার ফলশ্রুতি হিসেবে আজ আমার হাতে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী পড়াশুনা করছে। এরচেয়ে আনন্দ আর প্রাপ্তি কী হতে পারে। আমার এক ছাত্র বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সে একটা সময় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল। সেই ছাত্রকে আমি বুঝিয়ে মানসিকভাবে সাপোর্ট দিয়েছি। আজ সে ঢাকায় পড়াশুনা করছে। আরেকছাত্র নাজমুল, সে মেডিকেলে পড়ছে, তাকেও আমি নানাভাবে সাপোর্ট দিয়েছি। এখন আমার কতো ছাত্র। আমি তাদের নিয়েই বেঁচে আছি। এটাই আমার সাফল্য। আমি আমার এই অসংখ্য শিক্ষার্থীর মাঝে বেঁচে থাকতে চাই।
নিপা বিশ্বাসের মেয়ে মনিমুক্তা বলেন, ছোটবেলায় মাকে দেখেছি অনেক কষ্ট করে নিজের পড়াশুনা করেছেন। পাশাপাশি আমাকেও পড়াশুনা করিয়েছেন। আমার মা নিজের জন্য আর আমার জন্য প্রতিটি পদক্ষেপে যুদ্ধ করেছেন।
নিপা বিশ্বাসের মা লক্ষ্মী রাণী বিশ্বাস বলেন, আমার মেয়ে অনেক কষ্ট করে আজ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে। এটা অনেক গৌরবের বিষয়।
মাদারীপুর মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক নাজনীন আফরোজ বলেন, যারা জয়িতা পুরস্কার পান, তাদের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে একটা বাস্তব গল্প থাকে। যা দেখে বা শুনে অন্য নারীরা উৎসাহ পান। তেমনই একজন হচ্ছেন ডাসার উপজেলার নিপা বিশ্বাস। তিনি অনেক কষ্ট ও পরিশ্রম করে আজ নিজে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন। আজ তিনি একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। সেই প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে তিনি তার যোগ্যতায় সমাজে নিজের অবস্থান তৈরি করতে পেরেছেন। তাই এবার তিনি জয়িতা পুরস্কারও পেয়েছেন। তাই তাকে দেখে অন্য নারীরাও উৎসাহ পাবেন।
এফএ/জিকেএস