চিরকুমার কলি দাসের পাখিপ্রেম
পাবনার বেড়া উপজেলার কাগেশ্বরী নদীর পাড়ে কৈটলা গ্রাম। এই গ্রামেই সাড়ে ছয় বিঘা জমির উপর গড়ে উঠেছে পাখির অভয়াশ্রম। এখানে রয়েছে আম, কাঁঠাল, পাপনা, দেবদারু গাছ এবং ভারতীয় পার্সিমন, গাউবিসহ দেশি-বিদেশি অনেক গাছ। সব গাছই লাগানো হয়েছে পাখিদের কথা চিন্তা করে। এভাবেই নিজের বসতভিটাতে পশুপাখিদের জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে অভয়াশ্রম গড়ে তুলেছেন আকাশ কলি দাস। চিরকুমার এ মানুষটি পাখিপ্রেমেই কাটিয়ে দিয়েছেন তার জীবনের ৮৭টি বছর। পাখিদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণে এলাকায় তিনি ‘পাখিবন্ধু’নামে পরিচিত।
তার প্রকৃতি সেবায় সাথী হয়েছেন তার ছোট বোন ৬২ বছর বয়সী ঝর্ণা দাস। তিনিও ঘর সংসার করেননি। এদেশে আত্মীয়-স্বজন বলতে আর কেউই নেই তাদের। যারা আছেন, তারাও স্বাধীনতার আগে চলে গেছেন ভারতে। পুরনো মাটির চার চালা ঘরে বসবাস করেন দুই ভাই বোন। আরেকটি ছোট দোচালা ঘরে চলে ভাই-বোনের রান্নাসহ আনুষঙ্গিক কাজ। পাশে দুইটি গোয়াল ঘরও রয়েছে। তাদের ঘরের বেড়ার সঙ্গেও ডালি বাধা হয়েছে পাখিদের জন্য। কোলাহলমুক্ত পরিবেশ পাখির কলতানে মুখর হয়ে থাকে। ঝোপ-জঙ্গলে দেখা মেলে অচেনা পাখিদের। কুকুর-শিয়াল-সরীসৃপও দেখা যায়। আছে অতিথি পাখিও।
বাবা মায়ের ছয় সন্তানের মধ্যে বড় আকাশ কলি দাস। বাবা চন্দ্র কুমার দাস ছিলেন পাবনার বেড়া উপজেলার নগরবাড়ীর শ্রী নিবাস দিয়ার জমিদার বাড়ির নায়েব। মাত্র ১৭ বছর বয়সে বাবার মৃত্যুর পরে সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে। হারিয়ে যায় তার কৈশোর। পরে প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। সর্বশেষ তিনি স্থানীয় মাছখালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। নব্বইয়ের দশকে চাকরি থেকে অবসরে যান আকাশ কলি দাস। নিজের জীবনের প্রতি উদাসীন থাকলেও পরিবারের অভিভাবকের দায়িত্ব ঠিকই কাঁধে তুলে নেন। দুই বোন ও এক ভাইয়ের বিয়ে দেন প্রতিবেশী দেশ ভারতে। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর তার আর যোগাযোগ হয়নি ভাইয়ের সঙ্গে।
তার জীবনযাপন বেশ সাদা-মাটা। বাড়িতে তারা দুইজন ছাড়া আর কেউ নেই। সম্পত্তি নিয়ে তাদের কোনও চিন্তা বা মোহ নেই। গরু ও মাঠের দেখাশোনার জন্য রাখাল ও শ্রমিক আছে। তবে তারা কাজ শেষে যে যার বাড়িতে চলে যান। প্রতিবেশীরা জানান, মাঝে মাঝে আকাশের দেখা পাওয়া গেলেও কখনো বাইরে আসেন না ঝর্ণা।
আকাশ কলি দাসের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘প্রায় তিন যুগ আগে এখানে পাখি আসতে শুরু করে। প্রথমে দেশি পাখি আসলেও পরে অতিথি পাখিরাও আসতে শুরু করে। মূলত খাবারের পর্যাপ্ততা ও শিকারিদের দৌরাত্ম্য কম বলে এখানে পাখি আসে। পাখির আগমন দেখে তিনি পাখিদের প্রেমে পরেন। তাদের ভালোবেসে ফেলেন। চিন্তা করেন এখানে পাখিরা থাকবে নিরাপদে। তাই বনের কোন গাছ তিনি বিক্রি করেন না। শিকারিরা প্রথমে ঝামেলা করলেও গ্রামের মানুষের সাহায্যে তিনি সেসব মোকাবেলা করেছেন। কয়েক বছর আগে সরকারিভাবে এবং ওয়েটল্যান্ড বায়োডাইভারসিটি রিহ্যাবিলিটেশন প্রজেক্ট এ স্থানটিকে পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করেছে। তবে বর্তমানে পাখির উপস্থিতি কয়েক বছরের তুলনায় কমে গেছে। অভয়াশ্রমে পাখি শিকার না করলেও আশপাশে প্রচুর পাখি শিকার হয়। ফলে খাবারের খোঁজে নদীর তীর বা ধান ক্ষেতে গিয়ে অনেক পাখি আর ফিরে আসে না।’
আকাশ কলি দাস বলেন, ‘পশুপাখি ভালোবাসি। গাছগাছালি কাটি না; যাতে করে ওরা থাকতে পারে। আমি ওদের পাহারা দিয়ে রাখি। যাতে পাখিদের ওপর অত্যাচার না হয়, সে জন্য আমি ধীরে ধীরে এই জঙ্গল গড়ে তুলেছি। পাখিদের নিরাপত্তাই আমার একমাত্র দাবি।’
ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আকাশ কলি দাসের দাবি, ঠিক কী কারণে তিনি বিয়ে করেননি তা তিনি জানেন না। তবে সংসার জীবন পছন্দ হলেও ভাই-বোনদের বিয়ে ও দায়িত্ব নেওয়ার কারণে বিয়ে করা হয়নি বলে জানান তিনি। তবে বোন ঝর্ণাকে প্রথমে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও পরে রাজি না হওয়ায় তাকেও আর বিয়ে দেননি। এলাকার মানুষের মুখে শোনা যায়, পাখিদের ভালবেসেই তিনি বিয়ে করেননি। সারাদিন বনে বনে পাখির খোঁজ খবর নেওয়া, কোন পাখি আহত বা অসুস্থ হলে তার সেবা করা আবার শিকারিদের হাত থেকে পাখিদের বাঁচানোর চেষ্টা এসব নিয়েই সময় কেটেছে তার। ঝর্ণা দাস বেশিরভাগ সময় বই পড়ে সময় কাটান। ভাই আকাশ কলি দাস বইয়ের পাশাপাশি পশু-পাখি ও প্রকৃতির মাঝে সময় কাটান।
তিনি জানান, এক শ্রেণির ইউটিউবারদের জ্বালায় তিনি অতিষ্ঠ। তারা এসে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাড়িতে এসে ঘোরাফেরা করেন। ড্রোন উড়িয়ে ছবি তোলেন।
প্রতিবেশীরা জানান, কেউ পাখি শিকার করতে এলে কলি দাস তাদের বাধা দেন। তিনি মানুষ হিসেবে অনন্য। তিনি পশু-পাখির জন্য যেমন উদার তেমনি মানুষের বিপদ আপদে এগিয়ে যান।
কৈটোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মহসিন উদ্দিন পিপল বলেন, তিনি অত্যন্ত দানশীল মানুষ। উনার সাহায্যে অনেক ছেলে-মেয়ে শিক্ষিত হয়েছেন। আমাদের এলাকার অনেক কিছুতেই তার অবদান রয়েছে।
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘পাখিদের আশ্রয়ের জন্য বর্তমানে তেমন ব্যবস্থা নেই। এমন একটা পরিস্থিতিতে আকাশ কলি দাসের এ উদ্যোগ অনন্য নজির গড়ে তুলেছে। নতুন প্রজন্মের কাছে আকাশ কলি দাসের প্রকৃতি প্রেম উদাহরণ হয়ে থাকবে।
আমিন ইসলাম জুয়েল/এসআইটি/জিকেএস