তীব্র শীতে কর্মহীন শ্রমজীবীরা
‘কম্বল দিয়ে কি পেটের ক্ষুধা মেটে’
‘আমার কম্বল লাগবে না স্যার। কম্বল দিয়ে কি পেটের ক্ষুধা মেটে। শীতের চাইতে পেটের ক্ষুধার কষ্ট অনেক বেশি। সবাই শুধু আসে আর একটা করে কম্বল দিয়ে ছবি তুলে নিয়া যায়। কিন্তু আমার বাড়িতে সবাই যে না খায়া আছে, সেই কথা কারে বলমু’
শীতে ত্রাণের কম্বল পেয়েছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে এভাবেই নিজের ক্ষোভের কথা তুলে ধরেন ঠাকুরগাঁও রেলস্টেশনের প্লাটফর্মে রাত্রীযাপন করা দিনমজুর শফিকুল ইসলাম।
শফিকুল ইসলাম জানান, তিনি সাধারণত স্টেশনে রাত্রীযাপন করেন না। সদর উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামে তার বাড়ি। বাড়িতে ৫ সদস্যের পরিবার। পরিবারের সঙ্গে থাকতেই ভালো লাগে শফিকুলের। কিন্তু কিছুদিন যাবৎ তিনি চাল কেনার টাকা আয় করতে পারেননি। টাকা ছাড়া বাড়িতে গিয়ে স্ত্রী-সন্তান ও বৃদ্ধ মাকে ক্ষুধার্ত দেখার সাহস নেই তার। তাই তিনদিন ধরে স্টেশনের প্লাটফর্মে ঘুমাচ্ছেন তিনি।
জানা যায়, গত ১৫ দিনের মধ্যে ১০ দিনই কোনো কাজ পাননি শফিকুল। তিনি সাধারণত কৃষি জমিতে দিনমজুরি করে থাকেন। এই মৌসুমে আলুর ক্ষেতে কাজ করেন তিনি। তবে অতিমাত্রায় শীত ও কুয়াশা থাকায় ক্ষেত থেকে আলু তোলেননি চাষিরা। অন্যদিক থেকেও কোনো কাজের চাহিদা নেই। তাই প্রতিদিন কাজের সন্ধানে গেলেও কাজ না পেয়ে ফিরে আসতে হয় তাকে।
৩৫ বছর বয়সী শফিকুল ইসলাম বলেন, জানি না এখন আমার পরিবার কেমন আছে। বৃদ্ধ মা, ছোটো ছোটো দুইটা বাচ্চা, ওদের মুখে আহার উঠেছে কি না। হয়তো মা আর বৌ কারো কাছে হাত পেতেছে, সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে সন্তানদের মুখে ভাত তুলে দিয়েছে, এটাই সান্ত্বনা। আমিও সাহায্য তোলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমাকে কেউ ভিক্ষা বা সাহায্য দিতে চায় না। সবাই বলে জোয়ান লোক কাজ করে খাওনা কেন। কিন্তু কাজ না পাইলে কেমনে করমু।
শফিকুলের পাশে রাত্রীযাপন করা দিনমজুর রকি ৭ দিন থেকে কোনো কাজ পাননি। ইউসুফ নামের ৬২ বছর বয়সী আরেক দিনমজুর টানা ৬ দিন কোনো কাজ না পেয়ে অনাহারেই শুয়েছিলেন।
ইউসুফ আলী বলেন,‘আমারতো বয়স হয়ে গেছে। এমনিতে আমাকে কাজে কম নেয়। তার মধ্যে এখন কাজও কম। ভাবছিলাম শরীলে শক্তি থাকতে কখনও হাত পাতবো না। কিন্তু আরতো উপায় নাই। কাল থেকে হয়তো ভিক্ষাই করতে হবে।’
প্রতি বছরই শীত মৌসুমে ঠাকুরগাঁও ও এর আশপাশের অঞ্চলে কাজের সুযোগ কম থাকে। তবে এবার শীতে দিনমজুরি কাজের পরিমাণ অন্যান্য সময়ের তুলনায় আরও কমে গেছ। এ সময় অন্যান্য কাজের সুযোগ কমলেও বিভিন্ন ভবন নির্মাণের কাজ বেড়ে যেতো। তবে এ বছরে সেসকল কাজেরও দেখা পাচ্ছে না দিনমজুররা।
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান জানান, ঠাকুরগাও জেলায় মোট ৩৩৪৫০টি কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। শুকনা খাবার ১৮৩৭ প্যাকেট বরাদ্দ পাওয়া গেছে। যার পুরোটাই ৫ উপজেলায় দেওয়া হয়েছে। ৫০০০০ পিস কম্বলের জন্য এবং স্থানীয়ভাবে কম্বল কেনার জন্য ২০ লাখ টাকার চাহিদা পাঠানো হয়েছে। চলমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় যথাসাধ্য চেষ্টা করবে জেলা প্রশাসন।
তবে এই অঞ্চলের শীতার্ত নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য সরকারি বরাদ্দ বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন ড. মনোতোষ কুমার দে। তিনি বলেন, এই অঞ্চলে শীতকালীন পরিস্থিতি এখানে বসবাসকারীদের জন্য একটা বড় দুর্যোগ। নিচু এলাকার বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্যে যেমন পূর্ব প্রস্তুতি থাকে, এই অঞ্চলের শীত পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগে থেকে সরকারের বিশেষ কিছু প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। এই অঞ্চলের শীতার্তদের সহায়তার বরাদ্দ বাড়ানো যেতে পারে। সেইসঙ্গে যারা এই সময়ে কোনো কাজ করতে পারছে না বা কাজ পাচ্ছে না, তাদের জন্য সরকার বিশেষ কিছু পরিকল্পনা করতে পারে। সেইসঙ্গে এলাকার বিত্তবান ও বিভিন্ন এনজিও এগিয়ে আসার মাধ্য দিয়ে অসহায় মানুষের কাছে সহায়তা পৌঁছানো সহজ হবে।
এফএ/জেআইএম