পরিবারের চারজন প্রতিবন্ধী
নিজে চলতে না পারলেও পরিবারের হাল ধরতে চান জাকারিয়া
হাঁটতে পারেন না জাকারিয়া। হাতের গঠনও ভালো না। তাছাড়া শারীরিক গঠনে ছোট। অন্যের সাহায্য নিয়ে চলতে হয় তাকে। তবুও এই প্রতিবন্ধকতা দমাতে পারেনি মেধাবী জাকারিয়াকে। এবার এইচএসসি পাস করে অনর্সে ভর্তির অপেক্ষায় আছেন তিনি। পড়াশুনার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং করে প্রতি মাসে আয় করছেন টাকা। স্বাবলম্বী হতে চাওয়া জাকারিয়া স্বপ্ন দেখেন পরিবারের হাল ধরার।
জাকারিয়ার পরিবারে আরও তিনজন প্রতিবন্ধী রয়েছেন। তারা হলেন- তার বাবা বাবুল হাওলাদার (৫০), ছোটবোন লাবণ্য আক্তার (১৫) ও ছোটভাই জিহাদ হাওলাদার (১৩)। জাকারিয়ার বাবা খুড়িয়ে হাঁটতে পারলেও তিন সন্তান হাঁটতে পারেন না। অন্যের সহযোগিতায় চলাফেরা করতে হয় তাদের। মা জোসনা বেগমের সহযোগিতায় তাদের বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত করতে হয়।
জানা যায়, মাদারীপুর সদর উপজেলার শিরখাড়া ইউনিয়নের কুচিয়ামাড়া গ্রামের প্রতিবন্ধী বাবুল হাওলাদারের চার ছেলে মেয়ের মধ্যে তিনজনই শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। তারা কেউ হাঁটতে পারেন না। হাতও বাকা। তাছাড়া শারীরিক গঠনও ছোট। শুধুমাত্র একটি সন্তান ভালো আছেন।
বাড়িতে ঢুকতেই দেখা যায় উঠোনের এককোণে বসে আছেন প্রতিবন্ধী বাবা বাবুল হাওলাদার। আরেকপাশে প্রতিবন্ধী মেয়ে লাবণ্য আক্তার বসে তার মা জোসনা বেগমকে কাজে সহযোগিতা করছেন। আরেক প্রতিবন্ধী জিহাদ হাওলাদার বন্ধুর সঙ্গে বসে ক্রিকেট খেলছেন। আর জাকারিয়া ব্যস্ত ল্যাপটপে কাজ নিয়ে।
এ সময় তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাবুল হাওলাদারের বয়স যখন চার বছর, তখন তার জ্বর হয়। এরপর আস্তে আস্তে তার দুটি পা বাকা হয়ে যায়। পা বাকা হলেও তিনি একাই চলাফেরা করতে পারেন। বিয়ের পর তার প্রথম সন্তান ছেলে হয়। সবাই আদর করে নাম রাখেন জাকারিয়া। জন্মের পর স্বাভাবিক ছিলেন জাকারিয়া। দেখতেও খুব সুন্দর ছিলেন। বাবার মতো তারও তিন-চার বছর বয়সে জ্বর হয়ে আস্তে আস্তে শারীরিক গঠন বদলাতে থাকে। পা ও হাত আস্তে আস্তে বাঁকা হয়ে যায়।
এরপর মেয়ে লিয়া আক্তার (১৮) সুস্থ ও স্বাভাবিক হন। বর্তমানে তার বিয়ে হয়ে স্বামীর সংসারে আছেন। এরপর দুই সন্তান লাবণ্য ও জিহাদের অবস্থাও জাকারিয়ার মতো হয়।
একই পরিবারের তিন সন্তানসহ বাবা প্রতিবন্ধী হওয়ায় নেমে আসে চরম অন্ধকার। বাবা ঢাকায় ফেরি করে খেলনা বিক্রি করে মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার মতো আয় করেন। তা দিয়ে চালাতে হয় তাদের সংসার। নিজের একটি ঘরও নেই। তার এক চাচা তাদের ঘরে থাকতে দিয়েছেন। এই অভাবের মধ্যেই শুরু হয় জাকারিয়ার জীবন যুদ্ধ।
মায়ের অনুপ্রেরণায় জাকারিয়াসহ তার সব ভাই-বোন পড়াশুনা শুরু করেন। সুস্থ বোন লিয়া আক্তার এসএসসি পাস করার পর বিয়ে হয়ে যায়। এরপর আরেক প্রতিবন্ধী বোন লাবণ্য আক্তার স্থানীয় একটি মাদরাসায় ও ভাই জিহাদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চর্তুথ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করলেও এখন আর স্কুলে যায় না। তবে জাকারিয়া পড়াশুনা ছাড়েননি। তিনি হাজার কষ্টের মধ্যেও পড়াশুনা করে যাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, মাদারীপুর সদর উপজেলার শিরখাড়া ইউনিয়নের কুচিয়ামাড়া গ্রামের ৮১নং উত্তর কুচিয়ামারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন জাকারিয়া। এরপর শিরখাড়ার এ. কে. এস. ডি. আদেল উদ্দিন হাওলাদার স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে প্রথমে জেএসসি ও পরে এসএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন বাড়ি থেকে বেশ দূরে চরমুগরিয়া মহাবিদ্যালয়ে। সেখান থেকে এবার এইচএসসি পাস করেছেন তিনি। এখন ভর্তি হবেন মাদারীপুর সরকারি কলেজে। নিজের পড়াশোনার খরচ যোগাড় করতে তিনি ঘরে বসেই ল্যাপটপ দিয়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় করছেন। কিন্তু গ্রামের বাড়ি হওয়ায় ইন্টারনেট সমস্যায় ঠিকমতো কাজ করতে পারেন না জাকারিয়া। তবুও তিনি সমাজে বোঝা না হয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
প্রতিবন্ধী জাকাারিয়া বলেন, হাঁটতে না পারায় স্কুলে যেতে খুব সমস্যা হতো। কিন্তু আমার পড়াশুনার প্রতি প্রবল ইচ্ছা ও আগ্রহ ছিল। নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারলেও পড়াশুনা করে ভালো কোনো কাজ করে স্বাবলম্বী হতে চাই। তাই মায়ের সহযোগিতায় আমি এতদূর আসতে পেরেছি। প্রথমদিকে মা কোলে করে স্কুলে নিয়ে যেতো। অনেকেই আমাকে দেখে হাসাহাসি করতো। প্রথম দিকে মন খারাপ হতো। পরে স্বাবলম্বী হওয়ার চিন্তায় কারো কথায় আর মন খারাপ হতো না। এরপর একটি হুইল চেয়ার একজন উপহার দেন। সেই হুইল চেয়ারে করে মা প্রতিদিন আমাকে বিদ্যালয়ে নেওয়া-আনা করতো। এরপর কলেজে ভর্তি হই। সেখানেও অন্যের সহযোগিতা ছাড়া যেতে পারতাম না। ভ্যানগাড়িতে করে কলেজ গেট পর্যন্ত গেলে বন্ধুরা আমাকে দুইহাত ধরে উঁচু করে ক্লাসরুমে নিয়ে যেতো। আবার ছুটির পর একইভাবে তারাই ভ্যানগাড়িতে তুলে দিতো। এভাবেই আমি কলেজে আসা-যাওয়া করে এইচএসসি পাস করেছি। এখন অনার্সে ভর্তি হবো। তাছাড়া আমি নিজের পড়াশুনার খরচসহ সংসারে কিছু সহযোগিতার জন্য ফ্লিল্যান্সিংয়ের কাজ করে টাকা আয় করছি। তা দিয়ে কোনোভাবে চলছে আমাদের জীবন। তবে আমি আমার পরিবার বা সমাজের কাছে বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। আমি স্বাবলম্বী হতে চাই।
জাকারিয়ার বাবা বাবুল হাওলাদার বলেন, আমিসহ আমার তিন সন্তানই প্রতিবন্ধী। এর চেয়ে কষ্ট আর কী হতে পারে। তবে জাকারিয়া আমাদের অহংকার। কারণ ও নিজে হাঁটতে না পারলেও পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি কম্পিউটারের মাধ্যমে কাজ করে টাকাও আয় করছে।
প্রতিবেশী রফিকুল শিকদার বলেন, ছোটবেলা থেকে জাকারিয়া খুবই মেধাবী থাকায় এতদূর আসতে পেরেছে। আমরা সবাই মিলে ওর চলাফেরা করার জন্য একটি ইলেকট্রিক হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। এতে করে জাকারিয়ার চলাফেলা করতে একটু সুবিধা হয়েছে। তাছাড়া একই পরিবারের চারজন প্রতিবন্ধী হলে, সেই পরিবারের কী অবস্থা হয় তা বলে বোঝানো যাবে না।
শিরখাড়া ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের মেম্বার মো. সজীব খোন্দকার বলেন, জাকারিয়া নামের এই ছেলেটি প্রতিবন্ধী। হাঁটতে পারে না। শুধু জাকারিয়াই নয়, তার বাবাসহ একই পরিবারের চারজন প্রতিবন্ধী। ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক ও মর্মান্তিক। জাকারিয়া যেহেতু এইচএসসি পাস করেছে, এখনও পড়াশুনা করছে, তাই যদি প্রধানমন্ত্রী তার একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দিতেন, তাহলে পরিবারটির উপকার হতো। জাকারিয়াও স্বাবলম্বী হতে পারতেন।
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মো. মারুফুর রশিদ খান বলেন, জাকারিয়া অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। তার ও তার পরিবারের জন্য আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করবো। তাছাড়া খুব শিগগিরই ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে টাকা আয়ের জন্য ৬ মাসব্যাপী একটি প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হবে। সেখানে জাকারিয়াকে সুযোগ দেওয়া হবে। ও যদি ভালো করতে পারে, তাহলে ওর জন্য কাজেরও ব্যবস্থা করা হবে।
এফএ/জিকেএস