সবাইকে কাঁদিয়ে বিদায় নিলেন ইউএনও মামুন
সাপাহার উপজেলায় বৃহস্পতিবার (৭ ডিসেম্বর) শেষ কর্মদিবস ছিল ইউএনও আব্দুল্ল্যাহ আল মামুনের। সকালে অফিসে আসা মাত্রই উপজেলা পরিষদ চত্বরে ইউএনওকে দেখতে ভিড় জমান স্থানীয়রা। বিদায় বেলায় ইউএনও মামুনের সামনে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা।
বিমল মর্মু নামে এক প্রতিবন্ধী ইউএনওকে জড়িয়ে ধরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, স্যার আপনি এতো তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছেন। আপনার সহযোগিতা পেয়ে এখন তিনবেলা ঠিক মতো খেতে পারছি। আপনি গেলে আমাদের মতো অসহায়দের কে দেখবে?
শিরন্টি ইউনিয়নের বিন্নাকুড়ি গ্রামের প্রতিবন্ধী বিমল মর্মু জন্মের পর থেকেই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। তাই নিজে কাজ করে চলার মতো সক্ষমতা ছিল না তার। বিমল মর্মুর পরিবারের অন্য সদস্যরাও প্রতিবন্ধী। ২ মাস আগে নিজের দুর্দশার কথা জানিয়ে ইউএনও আব্দুল্ল্যাহ আল মামুনের কাছে সহযোগিতা চাইতে যান তিনি। ওই মুহূর্তে প্রতিবন্ধী বিমল মর্মুকে তার এলাকায় ৪০ হাজার টাকা খরচ করে একটি দোকান করে দেন ইউএনও মামুন। সেই দোকানের আয়েই বর্তমানে বিমল মর্মুর সংসার চলছে।
বিমল মর্মুর মতোই ইউএনও মামুনের কাছে সাহায্যের জন্য ছুটে গিয়েছিলেন সাপাহার সদর ইউনিয়নের মজিদপাড়া আশ্রয়ন প্রকল্পের বাসিন্দা শাহানাজ পারভীন। তিনি বলেন, চার মাস আগে সড়ক দুর্ঘটনায় আমার ৯ বছর বয়সী ছেলের গলার হাড় ভেঙে যায়। ছেলেকে চিকিৎসা করানোর মতো টাকা ছিল না। ইউএনও স্যারের সঙ্গে দেখা করার পর ৩৫ হাজার টাকা দিয়েছেন। ছেলেকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার জন্য আরও টাকার প্রয়োজন। স্যার আশ্বস্ত করেছিলেন আরও সহযোগিতা করবেন। এরমধ্যেই তিনি বদলি হলেন। এখন আমার ছেলের কী হবে?
সাপাহার উপজেলার একাধিক বাসিন্দা বলেন, অসহায় দুস্থরা তাদের প্রয়োজনে ইউএনও আব্দুল্ল্যাহ আল মামুনের কাছে গিয়ে কখনো খালিহাতে ফেরেনি। সকলের সঙ্গে হাস্যজ্জ্বলভাবে কথা বলতেন তিনি। সরকারি-বেসরকারি যেকোনো দপ্তরে কেউ হয়রানি হলে তা তাৎক্ষণিক সমাধান করতেন তিনি। অনেক অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থ্যাও নিয়েছেন। তাই তার কাছে গিয়ে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পেতো সবাই। উপজেলার সকল ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নয়নের পাশাপাশি অনেকের কর্মস্থান করে দিয়েছেন। তার মতো জনবান্ধব ইউএনওকে হারানো মেনে নেওয়া আমাদের জন্য কষ্টদায়ক।
২০২১ সালের ১৩ এপ্রিল সাপাহারে ইউএনও হিসেবে যোগদান করেন আব্দুল্ল্যাহ আল মামুন। এরপর করোনা মোকাবিলায় সম্মুখসারিতে থেকে কাজ করেছেন তিনি। করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রতিটি প্রান্তে ছুটে গিয়ে মানুষকে ঘরে থাকতে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে অনুরোধ করেছেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌঁছে দিয়েছেন খাদ্য সামগ্রী। এই কাজ করতে গিয়ে উপজেলার সর্বস্তরের মানুষদের অনেক কাছাকাছি পৌঁছানোর সুযোগ পেয়েছিলেন আব্দুল্ল্যাহ আল মামুন। ওই মুহূর্তে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা পরপর দুইবার করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
করোনার প্রাদুর্ভাব কমে যাওয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিলে করোনাকালীন শিক্ষার ঘাটতি পূরণে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেন আব্দুল্ল্যাহ আল মামুন। সুযোগ পেলেই তিনি ছুটে যেতেন উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। নানান গল্পের ছলে শ্রেণিকক্ষে গিয়ে নিজেই পাঠদান করতেন প্রাথমিক পর্যায়ের শিশুদের। অনুপ্রেরণা যোগাতেন মানুষ হয়ে দেশ ও জাতির জন্য কাজ করার। যার স্বীকৃতিস্বরূপ দুইবার জেলা এবং একবার বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ইউএনও নির্বাচিত হন।
সাপাহার উপজেলায় কাজ করতে গিয়ে শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ক্রীড়া, পর্যটনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে সাপাহারকে আধুনিক ও মডেল উপজেলায় রূপান্তর করেছেন আব্দুল্ল্যাহ আল মামুন। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি শুদ্ধাচার পুরস্কারও পেয়েছেন।
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে সোমবার (৪ ডিসেম্বর) এক প্রজ্ঞাপনে সারাদেশের ৪৭ জন ইউএনওকে বদলি করা হয়। সেই তালিকায় রয়েছে নওগাঁর সাপাহার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল্ল্যাহ আল মামুনের নাম। উপজেলায় দীর্ঘ ২ বছর ৮ মাস দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে গেছেন তিনি। তাই তার বদলির খবরে কান্নায় ভেঙে পড়েন উপজেলার হাজারো মানুষ।
এফএ/এএসএম