ছবি ভাইরাল
হৃদরোগে আক্রান্ত যুবদল নেতাকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে চিকিৎসা
এক হাতে ঝুলছে হাতকড়া অপর হাতে ইনজেকশনের ক্যানোলা আর দুপায়ে ডান্ডাবেড়ি পরা। এ অবস্থায় শুয়ে আছেন হাসপাতালের মেঝেতে। ডান্ডাবেড়ির কারণে দুই পা সোজাও করতে পারেননি। দুই পায়ের মাঝখানে পড়ে আছে ক্যাথেটার। রক্তমিশ্রিত প্রস্রাব সেখানে জমা হচ্ছে।
এভাবে ডান্ডাবেড়ি আর হাতকড়া পরিয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত এক যুবদল নেতার চিকিৎসা দেওয়ার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
খোজ নিয়ে জানা যায়, ওই ছবির ব্যক্তির নাম আমিনুর রহমান মধু। তিনি যশোর জেলা যুবদলের সহ-সভাপতি। এছাড়া তিনি সদর উপজেলার আমদাবাদ ডিগ্রি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাহিত্য ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক।
২৯ অক্টোবর রাতে যশোর নড়াইল রোডে দুটি বাসে ককটেল ও লাঠি পেট্রল জব্দের মামলায় বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিতসহ জেলার শীর্ষ ৮৭ নেতাকে আসামি করে মামলা করে পুলিশ। ওই মামলায় আসামি ছিলেন যুবদল নেতা আমিনুর রহমান মধু। এরপর হরতাল অবরোধের কর্মসূচিতে আরও দুটি নাশকতা মামলার আসামি ছিলেন তিনি।
গ্রেফতার আতঙ্কে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। কিন্তু ২ নভেম্বর সদর উপজেলার দেয়াড়া ইউনিয়নের আমদাবাদ গ্রাম থেকে পুলিশ আমিনুরকে আটক করে। এরপর ১২ নভেম্বর যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকা অবস্থায় আমিনুর রহমান মধু হৃদরোগে আক্রান্ত হন।
কারাগার থেকে তাকে হাতকড়া আর দুই পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে প্রথমে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ওই রাতেই তাকে ঢাকার কেরানীগঞ্জ কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। পরদিন ১৩ নভেম্বর কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তাকে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে ভর্তি করা হয়।
দুই পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে ও ডান হাতে হাতকড়া লাগানো অবস্থায় হাসপাতালের মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয় তাকে। আবার ওই হাতে একগুচ্ছ দড়ি পেঁচানো ছিল। তার শরীরে ডান্ডাবেড়ি এবং হাতকড়া এমনভাবে লাগানো যাতে সামান্য নড়েচড়ে বসারও সুযোগ নেই। কেবলমাত্র দুই হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া।
হাতকড়া আর ডান্ডাবেড়ি পরা আমিনুরের ছবিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ায় নানা আলোচনা সমালোচনা চলছে। পুলিশের এমন কাণ্ডে মর্মাহত তার পরিবার ও স্বজনরা। এমনটি সমীচীন নয় বলেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন আইনজীবীরা।
অভিযোগ আছে, সেখানে স্বজনদের আমিনুরের সান্নিধ্যে যেতে দেয়নি পুলিশ। এমনকি সময় মতো তাকে ওষুধও সেবন করতে দেওয়া হয়নি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, এখানে যারাই আসেন চিকিৎসা দেওয়া হয়। জেল থেকে যারা আসেন নিরাপত্তার খাতিরে তাদের অনেকেরই ডান্ডাবেড়ি পরানো থাকে। এটা কারা কর্তৃপক্ষ জানে।
আমিনুর রহমান মধুর স্ত্রী নাহিদা সুলতানা লাবনী বলেন, পরিবারের অভিভাবক গুরুতর অসুস্থ হয়ে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। আমি দুই সন্তানকে নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন। এ অবস্থায় তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে না। এরওপর কত অমানবিকভাবে দুই পায়ে ডান্ডাবেড়ি ও হাতকড়া পরিয়ে রাখে।
তিনি আরও বলেন, ২৯ নভেম্বর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে এনজিও গ্রাম করার কথা বলেছিল। এ জন্য তাকে মঙ্গলবার পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রাখতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তার আগেই কারা কর্তৃপক্ষ তাকে জোর করে হাসপাতাল থেকে কারাগারে নিয়ে গেছে।
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ) অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, বর্তমান সরকারের হাতে আইনের শাসন ও মানবাধিকার কতটুকু পর্যদস্তু হতে পারে, আমিনুর রহমান মধুকে জামিন না দেওয়া ও চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার ঘটনা তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।
চলতি বছরের শুরুতে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট ডান্ডাবেড়ি ও হাতকড়ার অপব্যবহার রোধ করতে পুলিশের মহাপরিদর্শক ও কারা মহাপরিদর্শক বরাবর আইনি নোটিশ দেন। নোটিশে বলা হয়, যদি কোনো শক্তিশালী বন্দি সহিংস অপরাধে অভিযুক্ত হন বা কুখ্যাত হিসেবে পূর্বপরিচিত হন বা অসুবিধা সৃষ্টিতে উন্মুখ থাকেন বা রাস্তা দীর্ঘ হয় বা বন্দির সংখ্যা অনেক বেশি হয়, সে ক্ষেত্রে হাতকড়া ব্যবহার করা যেতে পারে। হাতকড়া না থাকলে দড়ি বা কাপড় ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। প্রবিধানের কোথাও ডান্ডাবেড়ি ব্যবহারের কথা নেই। মূলত ডান্ডাবেড়ির ব্যবহার কেবল জেলকোড ও কারা আইনের আওতাধীন। বেঙ্গল পুলিশ রেগুলেশন অনুযায়ী প্রযোজ্য ক্ষেত্রে কেবল হাতকড়া ব্যবহারের সুযোগ আছে, ডান্ডাবেড়ি নয়।
এ বিষয় যশোর জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম এ গফুর বলেন, বিষয়টি খুবই অমানবিক। হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে এভাবে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে রেখে চিকিৎসা দেওয়া মোটেও সমীচীন নয়। আইন আদালত মানুষের কল্যাণের জন্য, অকল্যাণের জন্য নয়।
যশোর কলেজ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ইবাদত খান বলেন, দেশে আইন কাগজ কলমে আছে, বাস্তবে নেই। আমিনুর রহমান মধু যে রোগে অসুস্থ তাতে যে কোনো সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এরওপর একজন শিক্ষককে এমন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে রাখা দেশ ও জাতির জন্য খুবই লজ্জাজনক। তার স্ত্রী-সন্তান মানবেতর জীবনযাপন করছে। আশা করবো আদালত তাকে জামিন দিয়ে সুচিকিৎসার সুযোগ দেবে।
এ বিষয়ে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার শরিফুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানোর সময় কারাবিধি মতে নিরাপত্তার স্বার্থে তাকে ডান্ডাবেড়ি পরানো হয়েছিল। কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাকে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা শেষে মঙ্গলবার তাকে আবার যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়েছে।
মিলন রহমান/এসজে/এমএস