কাজ না করেই দুই কোটি টাকা লোপাট!
সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলায় ভুয়া প্রকল্প এবং নামমাত্র উন্নয়নের নামে টিআর (টেস্ট রিলিফ) ও কাবিখা প্রকল্পের দুই কোটি টাকা কাজ না করেই আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে চান্দাইকোনা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জান্নাতুল আলম সম্রাট ও সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম মানিকের বিরুদ্ধে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) যোগসাজশে ৫০টি প্রকল্পের ৮০ লাখ টাকা ও ১২ প্রকল্পের ৩২০ মেট্রিক টন চাল তুলে নিয়েছেন তারা। যার মূল্য প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা।
স্থানীয়রা এ ব্যাপারে সুষ্ঠু তদন্ত শেষে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি জনিয়েছেন। তবে অনিয়মের বিষয় অস্বীকার করেছেন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) গোলাম রব্বানী।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তৃপ্তি কনা মন্ডল বলেন, ভুয়া প্রকল্পের অনুকূলে অর্থ ছাড় করার কোনো সুযোগ নেই। তবে অভিযোগ পেলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন তিনি।
সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, রায়গঞ্জের ঢাকা-বগুড়া মহাসড়ক থেকে বামে ৩০০ মিটার এগুলে সরকারি নার্সিং ইনস্টিটিউট। এটির সামনের পাকা রাস্তা থেকে ২৫-৩০ মিটার দূরে সরকারি পানির ট্যাংক। এতটুকু দূরত্বের গলির মতো রাস্তাটা মেরামতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু স্থানীয় লোকজন বললেন, শুধু পানির ট্যাংকের কাছে তিন-চার ট্রাক ভিটি বালু ফেলা হয়েছে। পরিবহন খরচসহ এর মূল্য ৬ হাজার টাকার বেশি নয়।
অনিয়মের এই শেষ নয়, ওই ভিটি বালু থেকে কয়েক ডালি বালু সামনের ফকিরবাড়ির রাস্তায় ফেলা হয়েছে। যদিও সেখানে দেখানো হয়েছে ফকিরবাড়ি থেকে উৎপলের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামত নামে আরেক প্রকল্প। সম্প্রতি এক বিকেলে উৎপলের বাড়ির সামনে গেলে তার স্ত্রী কবিতা নাগ বললেন, মাথায় করে কয়েক ডালি মাটি ফেলা হয়েছে, এটুকুই।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখার তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষের দিকে ২০ ও ২১ জুন চান্দাইকোনা ইউনিয়নে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির ৫০টি প্রকল্পে ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। একইভাবে কাজের বিনিময়ে খাদ্যের (কাবিখা) ১২টি প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৩২০ মেট্রিক টন চাল। জুনে এক মেট্রিক টন চালের দাম ছিল ৩৮ হাজার টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সিরাজগঞ্জ-৩ (রায়গঞ্জ-তাড়াশ) আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডা. আব্দুল আজিজের আধা সরকারি পত্র (ডিও লেটার) অনুযায়ী মন্ত্রণালয় থেকে চান্দাইকোনায় ওই বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জিন্নাতুল আলম ও সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম বিশেষ বরাদ্দের এ কাজ করেছেন। নামমাত্র কাজ দেখিয়ে প্রকল্পের টাকা তুলে নিয়েছেন তারাই।
জানতে চাইলে সংসদ সদস্য আব্দুল আজিজ বলেন, এসব প্রকল্প বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করতে তিনি ইউএনও এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে (পিআইও) বলেছেন। কাজ সন্তোষজনক হলে তবেই বিল দেওয়ার কথা ছিল।
টিআর ও কাবিখার ৬২টি প্রকল্পের তালিকা ধরে সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কাবিখার বেশিরভাগ প্রকল্পের বাস্তবায়ন যেসব রাস্তায় দেখানো হয়েছে, টিআরের প্রকল্পের বাস্তবায়নও সেসব রাস্তায় দেখানো হয়েছে। কাবিখার একেকটি প্রকল্পে টাকার হিসাবে ৭ লাখ ৬০ হাজার থেকে ১৫ লাখ ২০ হাজার বরাদ্দ ছিল। কিন্তু স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, এসব প্রকল্পে গড়ে ৫০ হাজার টাকারও কাজ হয়নি। একইভাবে টিআরের প্রকল্পের প্রতিটিতে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু গড়ে ৫-৬ হাজার টাকার বেশি কাজ হয়নি।
ইউনিয়নের পাইরাভিটা বাজার থেকে নিঝুড়ি কবরস্থান পর্যন্ত একটি রাস্তা সংস্কারে বরাদ্দ ধরা হয় ২০ মেট্রিক টন চাল। টাকার হিসাবে তা ৭ লাখ ৬০ হাজার। এই রাস্তার মধ্যে আবার টিআরের চারটি প্রকল্প দেখানো হয়েছে। প্রতিটি প্রকল্পে বরাদ্দ ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এর মধ্যে নিঝুড়ির শহিদুলের বাড়ি থেকে সাহেবের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তাটি টিআর প্রকল্পে দু’বার দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ এক কিলোমিটারের কম দীর্ঘ এ রাস্তার পেছনে বরাদ্দ ছিল ১৪ লাখ টাকা।
পাইরাভিটা পাকা রাস্তা ধরে নিঝুড়ি গ্রামে গিয়ে দেখা গেলো, রাস্তাটি খানাখন্দে ভরা। কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা হাইজুল ইসলাম ও আরজিনা বেগমের সঙ্গে। তারা বলেন, এক-দেড় মাস আগে (আগস্টের শুরুর দিকে) মিনি ট্রাকে করে সাত-আট ভিটি বালু ফেলা হয়েছিল।
সবুজ তালুকদার নামের আরেকজন কবরস্থান পর্যন্ত রাস্তা দেখিয়ে জাগো নিউজকে বললেন, বৃষ্টির সময় রাস্তায় হাঁটুসমান কাদা হয়। মরদেহ ঘাড়ে নিয়ে কবরস্থানে যায় মানুষ।
কাবিখা প্রকল্পের সভাপতি স্থানীয় ইউপি সদস্য জহুরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী তাকে প্রকল্পের সভাপতি করা হয়েছে। কিন্তু কাজের দেখভাল করেছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। তার দাবি, কাবিখার কিছু কাজ হয়তো হয়েছে। কিন্তু টিআর প্রকল্পের বাস্তবায়ন সম্পর্কে তার জানা নেই।
ইউনিয়নের ঠাকুরপাড়া থেকে আলাউদ্দিনের বাড়ি হয়ে কাদেরের ইটভাটা পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারের প্রকল্পটিতেও বরাদ্দ ছিল ২০ মেট্রিক টন চাল।
প্রয়াত আলাউদ্দিনের ছেলে মতিউর রহমান ও এলাকার বাসিন্দা শাহাজান আলী বলেন, পাঁচ বছরের মধ্যে এ রাস্তায় কোনো মাটি ফেলা হয়নি। মতিনের ইটভাটা যেতে ছোট দুটি সেতু আছে। সেতুর দুই পাশে অল্প কিছু মাটি ফেলা হয়েছে।
এই প্রকল্পের সভাপতি ইউপি সদস্য হালিমা খাতুন জাগো নিউজকে বলেন, পদাধিকারবলে তাকে প্রকল্পের সভাপতি করা হলেও কাজ হয়েছে কিনা সেটা তিনি জানেন না।
এদিকে অভিযুক্ত ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জিন্নাতুল আলম সম্রাট প্রকল্পগুলোর কাজ ভালো হয়েছে দাবি করেন। পরে রায়গঞ্জের পিআইও গোলাম রব্বানী দাবি করেন, তারা সরেজমিনে কাজ দেখে বিল দিয়েছেন।
নামমাত্র কাজে বিল দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিশেষ বরাদ্দ বোঝেন তো কীভাবে আসে।
অনুরূপভাবে খোকশাহাট মন্দির থেকে করতোয়া নদী পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার বাবদ ৩০ মেট্রিক টন চাল অর্থাৎ ১১ লাখ ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়। মন্দিরের সামনে গেলে স্থানীয় বাসিন্দা সুধাংশু রায় ও ঝুলন বালা বলেন, কোনো মাটি কাটা হয়নি। শুধু ৩০০-৪০০ মিটার রাস্তা কোদাল দিয়ে মাটি সমান করে দিয়েছে।
চান্দাইকোনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নান খান বলেন, কারা কীভাবে এ প্রকল্প নিয়ে আসে এবং কোথায় বাস্তবায়ন করে সেটা তার জানা নেই।
এ প্রসঙ্গে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আকতারুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এফএ/এএসএম