খাদ্যগুদাম কর্মকর্তার চাল কেলেঙ্কারি তদন্তে সর্ষের মধ্যেই ভূত
শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলা খাদ্যগুদামের চাল কেলেঙ্কারির রেষ যেন কিছুতে কাটছে না। উপজেলা খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা ইকবাল মাহমুদ সরকারি চাল নিজ বাসভবনে অবৈধভাবে মজুত রেখে ও পরে সিলগালা বাসার গ্রিল কেটে জন্ম দেন দুটি বিতর্কের। এবার তদন্তের সময় গুদামে চালের হিসাবে গরমিল থাকায় বাইরে থেকে চাল এনে সেই হিসাব পরিপূর্ণ করতে সাহায্য করেন খোদ তদন্তকারী কর্মকর্তারাই। এ যেন সর্ষের মধ্যেই ভূতের অবস্থান।
ঘটে যাওয়া এই কাণ্ডের দুটি গোপন ভিডিও এরইমধ্যে জাগো নিউজের হাতে এসেছে। তবে এসব বিষয়ের কিছুই জানেন না বলে দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক।
উপজেলা প্রশাসন ও সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ১১ নভেম্বর (শনিবার) ১৩ বস্তা সরকারি চাল অবৈধভাবে মজুত রাখার দায়ে ভেদরগঞ্জ উপজেলা খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইকবাল মাহমুদের বাসভবনটি সিলগালা করে দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল্লাহ আল মামুন। এই ঘটনার পরদিন ১২ নভেম্বর (রোববার) সন্ধ্যায় সেই সিলগালা বাসভবনের জানালার গ্রিল কেটে মালামাল সরানোর সময় হাতেনাতে ধরা পড়েন ইকবাল মাহমুদ। তবে সেসময় একটি সাদা ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে যান ইকবাল মাহমুদকে সাহায্যকারী নৈশপ্রহরী আবু হানিফ। ধরা পড়ে ইকবাল মাহমুদ তার মোবাইল ফোন আর প্রয়োজনীয় জামাকাপড় বের করার জন্য গ্রিলটি কেটেছেন বলে দাবি করেন।
তবে অন্য একটি সূত্র বলছে ভিন্ন কথা। তাদের দাবি, সেদিন সিলগালা বাসার ভেতরে থাকা মোটা অংকের টাকা সরাতেই এমন কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন তিনি।
এদিকে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে আরেক নতুন বিতর্কের সৃষ্টি করেন ঘটনার তদন্তকারী কর্মকর্তারা। ঘটনার বিষয়ে সরেজমিন তদন্ত করতে ১৩ নভেম্বর (সোমবার) ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক। এতে সদস্য করা হয় ভেদরগঞ্জ উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নুরুল হক, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের কারিগরী খাদ্য পরিদর্শক মিজানুর রহমান ও জাজিরা উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সেলিম আহমদকে। তদন্তকালীন খাদ্য গুদামে ১৮ টন চালের ঘাটতি দেখা দিলে ১৪ নভেম্বর ১০ টন চাল ও ১৫ নভেম্বর ৮ টন চাল ট্রাকে করে বাইরে থেকে চাল এনে ওই তিন তদন্তকারী কর্মকর্তার উপস্থিতিতেই তাদের চালের হিসাব বুঝিয়ে দেন খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা ইকবাল মাহমুদ। এ যেন শাক দিয়ে মাছ ঢাকা।
বিষয়টি ভেদরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল্লাহ আল মামুন জানতে পেরে ওই তদন্তকারী তিন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করলে বাইরে থেকে খাদ্য গুদামে ১০ টন চাল ঢোকানোর বিষয়টি স্বীকার করেন তারা। বিষয়টি দুদককে অবহিত করা হলে গত ২০ নভেম্বর (সোমবার) ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন দুদকের একটি দল।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী উপজেলা খাদ্য গুদামের নিরাপত্তা প্রহরী মোক্তার হোসেন বলেন, ইকবাল মাহমুদ স্যার আসার পর যখন গোডাউন থেকে চাল সরিয়ে তার বাসায় রেখেছিলেন আমি তখন বলেছিলাম এটি অন্যায়। পরে আমি বিষয়টি ডিসি ফুড স্যারকে জানালে তিনি উল্টো আমাকে চুপ থাকতে বলেন। এই ঘটনার কিছুদিন পরই ইউএনও স্যার ইকবাল মাহমুদ স্যারের বাসা থেকে চাল জব্দ করে বাসা সিলগালা করে দেন। তার পরের দিন ইকবাল মাহমুদ স্যার সন্ধ্যায় মিস্ত্রি এনে বাসার গ্রিল কেটে আরেক নিরাপত্তা প্রহরী আবু হানিফকে নিয়ে বস্তা বের করছিলেন। তখন ইউএনও স্যার চলে আসলে আবু হানিফ কিছু বস্তা আর বাজারের একটি ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে যান। ওই ব্যাগ ভর্তি টাকা ছিল যেটা গ্রিল মিস্ত্রি দেখেছে।
গোডাউনে চাল ঢোকার বিষয়ে তিনি বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতেই গোডাউনে ট্রাকে করে চাল ঢুকেছে, আমি সেটা দেখেছি। ট্রাকের কিছু চাল গোডাউনে ঢুকিয়েছে আর অল্প কিছু চাল একটি মাদরাসায় গিয়েছে।
মোক্তার হোসেনের স্ত্রী ময়না বেগম বলেন, গ্রিল কাটার শব্দ পেয়ে আমি বাসা থেকে বের হই। পরে আমার স্বামীকে ফোন করে বিষয়টি জানাই। পরে ইউএনও স্যার আসেন, সঙ্গে আমার স্বামীও আসেন। ইউএনও স্যারের গাড়ির শব্দ পেয়েই আবু হানিফ আমাদের ঘরের সামনে দিয়ে একটা ব্যাগ নিয়ে দৌড় দিয়ে পালিয়ে যায়। পরে শুনতে পাই ওই ব্যাগের মধ্যে নাকি স্যারের টাকা ছিল।
এদিকে ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি প্রথমে অস্বীকার করেন নিরাপত্তা প্রহরী আবু হানিফ। একপর্যায়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে ভয়ে পালিয়ে ছিলেন বলে জানান তিনি। তবে তিনি শুধু ওই বাসা থেকে জামাকাপড় বের করেছেন, আর কিছুই নয় বলে দাবি করেন।
এ বিষয়ে শরীয়তপুর জেলা খাদ্য কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন বলেন, এরইমধ্যে ইকবাল মাহমুদকে রাজবাড়ী জেলার পাংশায় বদলি করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
এদিকে তদন্ত চলাকালে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের গোডাউনে চাল ঢোকানোর বিষয়ে কিছুই জানেন বলে দাবি করে তিনি বলেন, গোডাউনে চালের ঘাটতি ছিল কিনা আমার জানা নেই। তদন্ত প্রতিবেদনে এমন কিছু উল্লেখ করা হয়নি। তদন্ত কর্মকর্তারাই এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন। তবে তদন্ত করতে গিয়ে কেউ যদি অপরাধ করে থাকেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে ভেদরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, উপজেলা খাদ্যগুদাম কর্মকর্তার বাসায় ১৩ বস্তা চাল এবং ১ হাজার ১০০টি খালি চালের বস্তা জব্দসহ গুদামে ১৮ মেট্রিক টন চালের ঘাটতি ছিল। বিষয়টি আমি দুদককে জানাই। খাদ্য গুদাম থেকে যে ১৮ মেট্রিক টন চাল সরানো হয়েছিল তদন্তকারী কর্মকর্তারা বাহির থেকে সেই পরিমাণ চাল কিনে এনে গুদামের ঘাটতি পূরণ করেছেন। এই ঘটনায় পর্যাপ্ত পরিমাণ তথ্য প্রমাণ আমার হাতে থাকার কারণে তিন তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ উপজেলা খাদ্য গুদাম কর্মকর্তার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আমি দুদকে চিঠি পাঠিয়েছি।
এফএ/জেআইএম