ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

করতোয়ার জমি দখল করে টিএমএসএস’র ইকোপার্ক

নিজস্ব প্রতিবেদক | বগুড়া | প্রকাশিত: ০৬:৩৮ পিএম, ২২ নভেম্বর ২০২৩

<> নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে ইকোপার্ক নির্মাণ
<> প্রশাসনের তৎপরতা তালিকায় সীমাবদ্ধ
<> শহরে দখলকারীদের তালিকা লম্বা হচ্ছে দিনদিন

করতোয়া নদীর পাঁচ একর জমি দখল করে ইকোপার্ক গড়ে তুলেছে বগুড়ার বেসরকারি সংগঠন ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ (টিএমএসএস)। এতে গতিপথ পরিবর্তন হওয়াসহ নদীর একটি বড় অংশ নিজেদের সীমানার মধ্যে নিয়ে নিয়েছেন তারা। ওই এলাকায় নদীর আকৃতি পরিণত হয়েছে নালায়। ড্রোন ক্যামেরা ও স্যাটেলাইট ইমেজে ধরা পড়েছে আগ্রাসী এ পরিবর্তনে খরস্রোতা করতোয়াকে মেরে ফেলার চিত্র।

করতোয়া বাংলাদেশের অভিন্ন ৫৪ নদীর মধ্যে একটি। ঐতিহাসিক এ নদীর উৎপত্তি ভারতের হিমালয় পাদদেশে। আড়াই হাজার বছর আগের পুন্ড্রনগরও গড়ে উঠেছে করতোয়ার কোলেই। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলছে, নদী দখল ও দূষণকারীদের তালিকার মধ্যে টিএমএসএস অন্যতম। তাদের কাছে এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ, নদীর গতিপথ পাল্টে দেওয়া, বর্জ্য ফেলে ভরাট ও কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে নদীদূষণ, ড্রেজার যন্ত্র বসিয়ে অবৈধ বালু উত্তোলনের তথ্য আছে।

নদী যেভাবে টিএমএসএসের দখলে

সরকারি নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, করতোয়া নদীর পাশে মহিষবাথান মৌজার খাস খতিয়ান ১৫৫৩ দাগে মোট ১৬ দশমিক ৯৪ একর বদ্ধ জলাশয় বাংলা ১৩৯৭ থেকে ১৪০৫ সন পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে মহিষবাথান মৌজার ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত ১৫৫৩ দাগে ৪০ দশমিক ৯১ একর উন্মুক্ত জলাশয় হিসেবে ১৩৯৮ সনের জন্য ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘের পক্ষে শামছুল হক নামের এক ব্যক্তিকে ইজারা দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে (১৯৯৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি) তৎকালীন জেলা প্রশাসক নুরুজ্জামান ভূঁইয়া ১৫৫৩ দাগের খাসজমি ১৬ দশমিক ৯৪ একর আদর্শ গ্রাম প্রকল্পের আওতায় গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য ৯৯ বছরের লিজ দেন।

Bogura-pic-(3).jpg

ওইসময় টিএমএসএসের প্রধান নির্বাহী হোসনে আরা বেগম মহিষবাথান মৌজার ১৬ দশমিক ৯৪ একর ওই খাস সম্পত্তিতে স্বত্ব ঘোষণা, স্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়া, অন্য কাউকে লিজ না দেওয়ার প্রার্থনা করে বগুড়া যুগ্ম জেলা জজ প্রথম আদালতে একটি মামলা করেন। সেই মামলায় ২০০৯ সালের ৭ জুন তার পক্ষে রায় দেন আদালত।

তারপর থেকেই টিএমএসএস বদ্ধ জলাশয়সহ নদীর একটি অংশে বালু এবং ময়লা-আবর্জনা দিয়ে ভরাট করে চলেছে। লিজ নেওয়া ওই খাস জলাশয় পূরণ করে কিছু জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে স্থায়ী ভবন। গত মার্চে ‘মম ইন’ ইকোপার্কের পেছনে মাটি ও বর্জ্য ফেলে নদীর মূল প্রবাহ বন্ধ ও ভরাটের দায়ে টিএমএসএসকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেন জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসময় পাঁচটি ট্রাক জব্দ করা হয়।

এ ঘটনার পর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপ-সহকারী প্রকৌশলী হাসানুজ্জামান বাদী হয়ে টিএমএসএসের বিরুদ্ধে বগুড়া সদর থানায় মামলা করেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়, টিএমএসএস কর্তৃপক্ষ তাদের নির্দেশনা অমান্য করে নদী ভরাট করছিল, যা বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন-২০১২ অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ।

এরআগে ২০১৯ সালে বগুড়া সদরের নওদাপাড়ার বারবাকপুর মৌজা পরিমাপ করা হয়। সেসময় সড়ক ও জনপথ (সওজ), ভূমি সার্ভেয়ার, জেলা প্রশাসক কার্যালয় এবং টিএমএসএসের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ৬৪০৫ নম্বর দাগে সিএস নকশা অনুসারে নদীর একটি বড় অংশ দখল করার প্রমাণ মেলে। দখল করা স্থানে টিএমএসএসের সহযোগি প্রতিষ্ঠান ‘মম ইন’ ইকোপার্কের স্থায়ী অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে।

Bogura-pic-(3).jpg

পাউবো বগুড়ার সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ জানান, উচ্ছেদ হবে বুঝতে পেরে জমি পরিমাপ করার কিছুদিন পরেই জরিপ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর নারাজিনামা দেন টিএমএসএস নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. হোসনে আরা বেগম। এরপর বগুড়া জেলা প্রশাসক, পাউবো নির্বাহী প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করে আদালতে মামলা করেন, যা এখনো বিচারাধীন। পরবর্তী সময়ে তিনি বগুড়া থেকে অন্যত্র বদলি হলে উচ্ছেদের উদ্যোগ থেমে যায়।

নদীরক্ষা কমিশনের তৎপরতা

কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার ২০১৯ সালে বগুড়ার করতোয়া, যমুনা ও বাঙ্গালী নদী সরেজমিন পরিদর্শন করেন। সেই সময়ে বগুড়া জেলা প্রশাসকের কাছে দেওয়া তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নদীর জায়গা অবৈধভাবে দখলে নিয়ে টিএমএসএস ভবন বা স্থাপনা তৈরি অব্যাহত রেখেছে। তারা পার্কের ময়লা-আবর্জনা করতোয়া নদীতে ডাম্পিং করছেন। অবৈধভাবে নদী থেকে বালু তোলা হচ্ছে। এতে নদীর ভূগর্ভ ভেঙে তীর বসে যাচ্ছে। এছাড়া মমইন পার্ক নদীতে বাঁধ দিয়ে কৃত্রিম আইল্যান্ড তৈরি করেছে। এটি সম্পূর্ণ বেআইনি। জরুরি ভিত্তিতে এটি উচ্ছেদ করতে হবে। টিএমএসএস রাষ্ট্রের বা নদীর জায়গা অবৈধ দখলে জড়িত কারণে জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থি কাজের জন্য ফৌজদারি আইনে মামলা করতে হবে।

বর্তমান চিত্র

সরেজমিন ইকোপার্কের পেছনের অংশ ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে চার বছর আগে যে অংশটিকে কৃত্রিম আইল্যান্ড (দ্বীপ) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল তা এখন পার্কের ভেতরে চলে গেছে। নদীকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে জলাশয়। চারপাশে পিচঢালা পথ দিয়ে চলাচল করছেন পার্কে আসা লোকজন। সেখানে নদীর দৃশ্য অবলোকন করার জন্য ওয়াচরুম ও নৌকা ভ্রমণের জন্য জেটি স্ট্যান্ড তৈরি করা হয়েছে। বিস্তৃত নদীর চারভাগের তিনভাগ অংশ বন্ধ করার কারণে সেখানে সরু নালার আকৃতি পেয়েছে নদীটি।

Bogura-pic-(3).jpg

স্থানীয় পল্লী মঙ্গল ঈদগাহ মাঠের সেক্রেটারি আবু সাইদ বলেন, ‘নদীর অপর পাশে সরকারি জমি লিজ নেওয়া রয়েছে বলে দাবি টিএমএসএসের। এ কারণে তারা নদীর পানিপ্রবাহ বন্ধ করে পুরো নদীকেই তাদের সীমানায় নিতে চান। এ কারণে রাতদিন মাটি ফেলে নদী ভরাট করে চলেছেন তারা।’

নদী বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) রাজশাহী ও রংপুর বিভাগীয় সমন্বয়কারী তন্ময় কুমার সান্যাল বলেন, ‘বগুড়ায় জেলা প্রশাসনের তৈরি করা দখলকারীদের দুটি তালিকাতেই টিএমএসএসের নাম রয়েছে। এছাড়া গোকুলে মেরিন একাডেমি তৈরির নামেও তারা নদীকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছেন। বিভিন্ন সময় প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর চেষ্টা করলেও লাভ হয়নি। নদী দখল চলছে একই গতিতে। এক্ষেত্রে তাদের খুঁটির জোর কোথাই সেই বিষয়টিও রহস্যজনক।’

পরিবেশ সচেতনতা ও নদী নিয়ে গবেষণা করেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) বাংলা বিভাগের প্রধান ও কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবু ছালেহ মোহাম্মদ ওয়াদুদুর রহমান (তুহিন ওয়াদুদ)।

তিনি বলেন, বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও এএলআরডির (অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদাসহ আমরা অনেকেই করতোয়া নদী পরিদর্শন করেছি। সেখানে বগুড়ার মহিষবাথান এলাকায় নদী দখলের চিত্র একেবারে স্পষ্ট।

নদীর সীমানা প্রসঙ্গে তুহিন ওয়াদুদের ভাষ্য, পরিমাপ করতে নদীকে প্রথমে চোখ দিয়ে দেখতে হয়, তারপর কাগজ ধরে। বর্তমানে ওই স্থানে মূল প্রবাহই বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, টিএমএসএস ৯৯ বছরের জন্য নদীর জমি ইজারা নেওয়ার দাবি করে আসছে। কিন্তু সরকার কীভাবে এ জমি ইজারা দিয়েছে, সেটি বোধগম্য নয়।

টিএমএসএসের ব্যাখ্যা

টিএমএসএসের নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরার সঙ্গে সরাসরি এ বিষয়ে কথা বলা যায়নি। তবে তিনি বিভিন্ন সময় মিডিয়ায় এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এতে দাবি করা হয়েছে, ওই জমি সরকারের কাছ থেকে ১৯৯৫ সালে ৯৯ বছরের জন্য তারা ইজারা নিয়েছেন। টিএমএসএস নদী দখল করে না। নদী দখলের প্রমাণও নেই কোথাও।

Bogura-pic-(3).jpg

টিএমএসএসের দাবি, নদীয় দুই তীরের পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় তাদের প্রতিষ্ঠানের ১০২ একর জমি রয়েছে। নদীভাঙনে তাদের ৪০ একর জমি বিলীন হয়েছে। এখন তাদের কোনো স্থাপনা নদী দখল করে করা হয়নি।

জেলা প্রশাসনের দখলকারী তালিকা প্রসঙ্গে টিএমএসএসের বক্তব্য, এটি বিভ্রান্তকর। এ তালিকা থেকে নাম অপসারণ করতে তারা আবেদন করেছেন।

শহরে দখলদার যারা

এ তালিকাতেও রয়েছে টিএমএসএসের নাম। নবাববাড়ি মৌজায় ১৭১৬ দাগে তাদের পৌনে এক শতক ও সূত্রাপুর এলাকার ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ প্রায় দেড় শতক জমি দখল করে সীমানা প্রাচীর দিয়েছেন। এছাড়া ফুলবাড়ীর খায়রুজ্জামান ৯৬ বর্গফুট, রাজাবাজারের আব্দুস সোবাহান ৫৪৬ বর্গফুট, শংকর বাবু ও কানাই লাল মিলে ৭১ বর্গফুট দখল করে চালাঘর ও পাকা ভবন নির্মাণ করেছেন।

ফতেহ আলী আল আরাবিয়াতুন খালাফিয়া ওয়া হাফিজিয়া মাদরাসা ও মসজিদে মোবারক নামে ২০৯ বর্গফুট, নবাববাড়ি সড়কের একেএম ফজলুর রহমান ৮০ বর্গফুট, মোক্তার হোসেন ২৪ বর্গফুট, জোবাইদুল ইসলাম ৫০০ বর্গফুট, মতিয়ার রহমান ৯০০ বর্গফুট, মাজেদ হোসেন ১৮০ বর্গফুট, গুপিনাথ মন্দিরের সভাপতি আনন্দ ৪০৯ বর্গফুট, সঞ্জীব কুমার বিহানী ২৪০ বর্গফুট, প্রদীপ কুমার রায় ৫৪৪ বর্গফুট ও আব্দুল জলিল ১৫০ বর্গফুট জায়গা অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন।

এ বিষয়ে বগুড়ার বর্তমান জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, নদী দখল-দূষণের বিষয়ে আমরা জিরো টলারেন্স অবস্থানে আছি। অবৈধভাবে কেউ নদী দখল-দূষণ করলে তাদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, টিএমএসএসের নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরা বেগমের সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি। তার দাবি, নদীর পাশে তাদের জায়গা রয়েছে। এ কারণে ওই স্থানে ফের পরিমাপ করা হবে। যদি প্রমাণ হয় নদীর জায়গা টিএমএসএসের দখলে রয়েছে তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এসআর/এমএস