কক্সবাজারবাসীর স্বপ্ন পূরণের দিন
আইকনিক রেলস্টেশন উদ্বোধনে শেষ হচ্ছে প্রতীক্ষা
ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তান আমল এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের স্বপ্ন ছিল দেশের সর্বদক্ষিণের জেলা কক্সবাজারের সঙ্গে সারাদেশের সরাসরি রেল সংযোগ। স্বাধীনতা পরবর্তী একাধিক সরকার ৩৫ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। কিন্তু কোনো সরকারই কক্সবাজারে রেল সংযোগের কাজ হাতে নেয়নি। তবে ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পরই রেল সংযোগে সারাদেশের সঙ্গে কক্সবাজারকে যুক্ত করতে প্রকল্প হাতে নেয় আওয়ামী লীগ সরকার।
সেই প্রকল্পের হাত ধরেই বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আন্তর্জাতিক মানের আইকনিক রেলস্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে পর্যটন শহর কক্সবাজারে। এই স্টেশনে রয়েছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত সবধরনের ব্যবস্থা। শুধু রেল যোগাযোগের জন্য নয়, পর্যটনের নতুন অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচ্য হচ্ছে দেশের একমাত্র আইকনিক এই রেলস্টেশন, এমনটি অভিমত কক্সবাজারের সচেতন মহলের।
ব্রিটিশ ও স্বাধীনতা পরবর্তী ১০০ বছরের প্রতীক্ষার পালা শেষ হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নান্দনিক আইকনিক রেলস্টেশন ও দোহাজারী-কক্সবাজার নবনির্মিত রেললাইনের উদ্বোধন করবেন আজ (শনিবার)। শুধু রেলপথ ও আইকনিক রেলস্টেশন নয়, এদিন সমাপ্ত হওয়া ১৩টি প্রকল্প উদ্বোধন এবং তিনটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য ফলক তৈরি করা হয়েছে। উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তরযোগ্য প্রকল্পগুলোর মোট ব্যয় ৫৫ হাজার কোটি টাকা।
আরও পড়ুন: কক্সবাজারে এলো প্রথম কোনো ট্রেন, উচ্ছ্বসিত দর্শনার্থীরা
জেলা প্রশাসন সূত্রমতে, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে ঝিলংজায় ২৯ একর জমিতে ২১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে চোখধাঁধানো আইকনিক রেলওয়ে স্টেশন। পুরো স্টেশনের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে চারপাশে ব্যবহার করা হয়েছে কাচ। ছাদের ওপর ব্যবহার করা হয়েছে অত্যাধুনিক স্টিল ক্যানোফি। ফলে দিনের বেলা বাড়তি আলো ব্যবহার করতে হবে না স্টেশনে। আর অত্যাধুনিক নির্মাণশৈলীর কারণেই একে বলা হচ্ছে ‘গ্রিন স্টেশন’।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপ্রকল্পের পরিচালক মো. সুবক্তগীন গণমাধ্যমকে বলেন, ছয়তলার এই স্টেশনে রয়েছে চলন্ত সিঁড়ি, মালামাল রাখার লকার, হোটেল, রেস্তোরাঁ, শপিংমলসহ আধুনিক সব সুবিধা। ৪৬ হাজার মানুষের ধারণক্ষমতা সম্বলিত স্টেশনটি সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। যেখানে আছে কনভেনশন হল, ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন বুথ, এটিএম বুথ, প্রার্থনার স্থানও। স্টেশনে ফুড কোর্ট, হোটেল ও শপিং কমপ্লেক্সের বিষয়টি বাইরের এজেন্সি দ্বারা টেন্ডারিংয়ের মাধ্যমে পরিচালনা করা হবে।
আইকনিক ভবন ও আশপাশের রেলপথ নির্মাণ কাজের প্রকৌশলী এনামুল হক সরকার এনাম বলেন, অবকাঠামোসহ আইকনিক স্টেশন ভবন পর্যটক বরণে পুরোপুরি প্রস্তুত। সামগ্রিকভাবে প্রায় ৯২ শতাংশ কাজ শেষ। রেলপথের সক্ষমতা যাচাইয়ে ৫ নভেম্বর পরিদর্শন রেল এসে ঘুরে গেছে। আজ উদ্বোধনের জন্য স্টেশনে এসেছে আধুনিক সুবিধার একটি ট্রেন। উদ্বোধনের পরপরই সম্ভব না হলেও মাস দেড়েক পর বাণিজ্যিকভাবে কক্সবাজারে রেল যোগাযোগ শুরু করা যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। তবে কার্যাদেশ অনুসারে চলতি অর্থবছরের শেষ সময়ে আমাদের কাজ পুরোপুরি বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি মো. খোরশেদ আলম ও কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মাহবুবুর রহমান বলেন, একাদশ জাতীয় নির্বাচনে জেলার চার আসনে নৌকার প্রার্থী জয়ী হলেও স্বাধীনতা পরবর্তী কক্সবাজারে আওয়ামী লীগবিরোধী মতাদর্শই বেশি লক্ষণীয়। এসব চিত্র এড়িয়ে টানা তিনবারে সরকার গঠন করা আওয়ামী লীগ কক্সবাজারকে ঘিরে লক্ষ কোটি টাকার মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এরমধ্যে রেল, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও মাতারবাড়ী তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। শনিবার এসবের সঙ্গে ১৭ প্রকল্প উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। তাই একে কক্সবাজারবাসীর স্বপ্নপূরণের দিনই বলা যায়।
আরও পড়ুন: বদলে যাওয়া ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে দর্শনার্থীর ভিড়
কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান বলেন, এত উন্নয়ন অতীতে কোনো সরকার করতে পারেনি। দেশরত্ন শেখ হাসিনার বদান্যতায় উদ্বোধন হতে যাওয়া রেলপথ ও আইকনিক স্টেশন জেলাবাসীর শতবছরের স্বপ্ন পূরণ করেছে। বাস্তবায়িত ও চলমান প্রকল্পের সূত্রধরে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে জেলাবাসী নৌকার জয় সুনিশ্চিত করবেন বলে আশাবাদী আমরা।
কক্সবাজারের পর্যটন উদ্যোক্তা ও তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইজের চেয়ারম্যান এম এন করিম বলেন, বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকতসমেত কক্সবাজার ঘিরে পর্যটন একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। একে আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছাতে উদ্বোধন হতে যাওয়া রেলপথ অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। সমৃদ্ধ হবে পর্যটন শিল্প- এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
খুরুশকুল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ রিয়াদ বলেন, কক্সবাজারের সঙ্গে উপকূলের বাধাহীন যোগাযোগ স্থাপনের দাবি দীর্ঘদিনের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই দাবিও বাস্তবায়ন করে চট্টগ্রামের মিরসরাই-কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভে সংযোগের জন্য ২৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে কস্তরাঘাটে নির্মাণ করেছেন প্রায় ৬০০ মিটার দীর্ঘ দৃষ্টিনন্দন সেতু। শনিবার এটিও উন্মুক্ত করা হচ্ছে। দ্বাদশ নির্বাচনের আগে এতগুলো স্বপ্ন বাস্তবায়নে দলীয় নেতাকর্মীসহ আমজনতা খুবই খুশি।
কক্সবাজার সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ওয়াহিদ রহমান রুবেল বলেন, শনিবার আমাদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণের দিন। এত উন্নয়নের পরও নৌকায় ভোট না দেওয়া চরম বেঈমানি ও অকৃতজ্ঞতা হবে।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, রেলপথ-আইকনিক স্টেশন, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর এবং তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনের মাধ্যমে কক্সবাজারে শিল্প উদ্যোক্তা বাড়বে বলে আশা করা যায়। যোগাযোগ সহজতর হলে সমৃদ্ধ হবে পর্যটনও।
দোহাজারী-কক্সবাজার ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১০ শুরু হয়ে ২০১৩ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে, ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল একনেকে অনুমোদিত হয় এবং এ লাইনে ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৮৫২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। কিন্তু জমি অধিগ্রহণসহ অন্যান্য ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ২০১৬ সালে সংশোধিত প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকায়। এ বাজেটে এডিবি ঋণ দেয় ১৩ হাজার ১১৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা আর বাকি চার হাজার ৯১৯ কোটি সাত লাখ টাকা সরকারি তহবিল থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: হিমছড়ির নতুন পর্যটন স্পট
একনেকে অনুমোদনের পর প্রকল্পের মেয়াদকাল ২০১০ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন ধরা হয়। এ রেলপথ নির্মাণে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় এক হাজার ৩৬৫ একর জমি অধিগ্রহণ করে ঠিকাদারকে বুঝিয়ে দিতে বিলম্ব হয়। প্রকল্পে পড়া ১৬৫ একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল ডি-রিজার্ভকরণসহ প্রকল্পে ব্যবহারে অনুমতি পেতে কালক্ষেপণ হয়। ২০১৯ সালের শেষাংশে শুরু হয় সংরক্ষিত বনাঞ্চলভুক্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকার গাছপালা কাটা ও ভৌত কাজ।
পিজিসিবি, বিপিডিবি ও বিআইবির বৈদ্যুতিক টাওয়ার ও পোল স্থানান্তরে চারদফা বৈঠক হয় আন্তঃমন্ত্রণালয়ে। এসবের সঙ্গে যোগ হয় করোনা মহামারি। ২০২০ সালে প্রায় দেড়মাস বন্ধ থাকায় প্রকল্পের কাজে বিঘ্ন ঘটে। বিশ্বব্যাপী লকডাউনের কারণে বিভিন্ন মালামাল সঠিক সময়ে দেশে এসে পৌঁছেনি। এ পরিপ্রেক্ষিতে সবকাজ শেষ হতে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এ সময়ের আগে আজ প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার রেলপথ ও আইকনিক রেলস্টেশন উদ্বোধন করছেন।
সায়ীদ আলমগীর/বিএ