ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

ধাত্রীসেবায় চারটা যুগ কেটে গেলো আনোয়ারার

আয়শা সিদ্দিকা আকাশী | প্রকাশিত: ০৪:২৭ পিএম, ১৮ অক্টোবর ২০২৩

মাত্র ১৩ বছর বয়সেই বিয়ে হয়ে যায় মাদারীপুরের আনোয়ারা রাজ্জাক আনু চৌধুরীর। অপ্রাপ্ত বয়সেই মা হতে হয়েছে তাকে। পরপর চার ছেলে সন্তানের মা হন তিনি। এখন ধাত্রীকে সেবা দেওয়াটাই তার নেশা। ৪৮ বছর ধরে এ সেবা দিয়ে আসছেন তিনি। এ পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি মাকে এ সেবা দিয়েছেন আনোয়ারা রাজ্জাক।

স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৫২ সালের ৩ জুন মাদারীপুর শহরের ৪ নম্বর শকুনি এলাকায় জন্ম আনোয়ারা রাজ্জাক আনু চৌধুরীর। বাবা মৃত চৌধুরী আতাহার উদ্দিন, মা সেতারা বেগম। অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় মাদারীপুর সদর উপজেলা ঝাউদি ইউনিয়নের হোগলপাতিয়া গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক মিয়ার সঙ্গে আনোয়ারার বিয়ে হয়। বিয়ের পর স্বামীর উৎসাহে পড়াশোনা চালিয়ে যান।

jagonews24

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে এসএসসি ও ১৯৭৪ সালে এইচএসসি পাস করেন আনোয়ারা। তখন তার স্বামী পৌরসভায় চাকরি করতেন। তিনিও সংসার সামলিয়ে চাকরি করতেন একটি এনজিওতে। সেই সময় থেকে নারীদের নিয়ে কাজ করা শুরু করেন আনোয়ারা। দীর্ঘ সাত বছর ঝাউদি ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারও ছিলেন তিনি। তবে তার জীবনের চারটি যুগ চলে গেছে ধাত্রী সেবায়।

আরও পড়ুন: গরিবের হোটেলের ৪০ টাকার খাবার এখন ১০০

মাদারীপুর শহরের ২ নম্বর শকুনি এলাকার গৃহবধূ ফারজানা আক্তার মুন্নি বলেন, ‘তিনি (আনোয়ারা) শুধু প্রসবকালীন সেবা নয়, নারীদের যেকোনো নির্যাতনের বিষয়ে এগিয়ে আসেন। তার হাতেই আমার প্রথম সন্তান হয়েছে।’

jagonews24

পানিছত্র এলাকার আরজু বেগম (৩৫) বলেন, ‘আমার তিন সন্তান তার হাতেই হয়েছে। কোনো অপারেশন লাগেনি। এজন্য তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’

শকুনি এলাকার আম্বিয়া বেগম (৪০) বলেন, ‘আমার প্রসব ব্যথা উঠলে পরিবারের লোকজন আমাকে আনোয়ারা রাজ্জাকের কাছে নিয়ে যান। বিনা অপারেশনে তার হাতেই আমার প্রথম সন্তান হয়। পরে দ্বিতীয় সন্তান হওয়ার সময়ও তার কাছে যাই।’

দুধখালী গ্রামের মিতালী বেগম, পাচখোলা গ্রামের জুলেখা বেগম, মহিষেরচর গ্রামের শেফালীসহ একাধিক নারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। তাই ডাক্তারের কাছে যেতে সাহস করিনি। পরে শহরে গিয়ে আনোয়ারা রাজ্জাকের সহযোগিতায় মা হয়েছি। তিনি আমাদের অনেক উপকার করেছেন।’

আরও পড়ুন: ইউপি সচিব হয়েও তিনি আওয়ামী লীগ নেতা

কুকরাইল এলাকার রাজিয়া বেগম, শকুনি এলাকার লাইজু বেগম, হাজির হাওলা গ্রামের জাকিয়া সুলতানা, থানতলী গ্রামের সিমা ও মুন্নিসহ তিন হাজারের বেশি মায়ের সেবা করেছেন আনোয়ারা রাজ্জাক।

jagonews24

ধাত্রীসেবার বিষয়ে জানতে চাইলে আনোয়ারা রাজ্জাক আনু চৌধুরী বলেন, ‘আমার শাশুড়ি বলতেন, বিনা টাকায় ১০১টা মায়ের সন্তান প্রসবে সহযোগিতা করলে তার আর কবরের আজাব হবে না। ধর্মীয় এ চিন্তা থেকেই ধাত্রীর কাজ শুরু করি। বিনা টাকায় চিকিৎসাসেবা পাওয়ায় অল্প দিনেই আমার এ সেবার কথা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে। দূর-দূরান্ত থেকে মায়েরা আমার খোঁজে আসতে থাকেন।’

তিনি বলেন, ‘দিনে দিনে চাহিদা বেড়ে গেলে নিজ বাড়িতেই ছোট একটা ঘর তুলি। পরে সেই ঘরেই দীর্ঘ বছর ধরে এ ধাত্রীর কাজ করেছি। বিভিন্ন প্রশিক্ষণও নিয়েছি যাতে কোনো মায়ের সমস্যা না হয়। তবে কোনো মায়ের অবস্থা খারাপ হলে বা পেটে সন্তানের কোনো ধরনের সমস্যা মনে হলে তাকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে পাঠাতাম। তবে দুই বছর হলো ওই বাড়ি বিক্রি করে বর্তমানে পানিছত্র এলাকায় নতুন বাড়ি করে থাকছি। এখানেও মানুষজন আসে। কিন্তু বয়স হওয়ার কারণে এখন আর আগের মতো সেবা দিতে পারি না।’

আরও পড়ুন: ‘পরিস্থিতি এমন থাকলে না খেয়ে মরতে হবে’

মাদারীপুরের জাগো মানবতা উন্নয়ন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ফারজানা আক্তার। তিনি বলেন, ‘আমি আনোয়ারা রাজ্জাককে চিনি ও জানি। তার কাছে গেলে তিনি নারীদের প্রয়োজন অনুযায়ী সহযোগিতা করে থাকেন। বিশেষ করে মায়েদের প্রসবের ব্যাপারে।’

jagonews24

তিনি বলেন, আনোয়ারা এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তবে কোনো মায়ের যদি অপারেশন করানো দরকার হয়, তাহলে তিনি সেসব মায়েদের দ্রুত সরকারি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। তার প্রতি সবার আস্থা আছে।

আরেক উন্নয়ন সংস্থা নকশি কাঁথার সদস্য তানমিরা জেবু জাগো নিউজকে বলেন, বাল্যবিয়ের শিকার হয়েও নিজেকে শিক্ষিত ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মাদারীপুরের আনোয়ারা রাজ্জাক। এটা নারীদের জন্য অনুপ্রেরণা।

এ বিষয়ে মাদারীপুর মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) মাহমুদা আক্তার কণা বলেন, আনোয়ারা রাজ্জাক দীর্ঘ সময় ধরে ধাত্রী সেবা দিয়ে আসছেন। ধাত্রী সেবায় তিনি অনেক দক্ষ। শহরের পাশাপাশি গ্রামের মেয়েরাও তার কাছে আসেন এ সেবা নিতে। জেলাজুড়ে এ কাজের জন্য তার অনেক সুনামও আছে।

এসআর/জিকেএস