ময়মনসিংহে একদিনের বৃষ্টিতে মৎস্য খাতে ক্ষতি ৬৪৫ কোটি টাকা
ময়মনসিংহে একদিনের বৃষ্টিতে মৎস্য খাতে ক্ষতি হয়েছে ৬৪৫ কোটি টাকা। একই সঙ্গে ধান ও সবজি তলিয়ে গেছে প্রায় ৩৬ হাজার ৮৫৮ হেক্টর জমির।
সোমবার (৯ অক্টোবর) বিকেলে জেলা মৎস্য অধিদপ্তর ও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস জাগো নিউজকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) দিন ও রাতভর রেকর্ড বৃষ্টিতে পুরো জেলাজুড়ে এ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সেদিন ময়মনসিংহ জেলায় ২৪ ঘণ্টায় ৩৭৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। এর আগে ১৯৭১ সালে ৩৮১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, জেলায় বড় আকারের বাণিজ্যিক খামার রয়েছে অন্তত ৭৪ হাজার। অবাণিজ্যিক ও ছোট আকারের পুকুর আছে এক লাখ ৬৩ হাজার। মাছচাষি প্রায় এক লাখ ১২ হাজার জন। চলতি বছর চার লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। যার বাজারমূল্য অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু একদিনের বৃষ্টিতে ৪১ হাজার পুকুর তলিয়ে গেছে। এতে মাছ ও অবকাঠামোসহ মোট ৬৪৫ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
অন্যদিকে জেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, চলতি আমন মৌসুমে জেলায় ২ লাখ ৬৮ হাজার ৪৯৫ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষ হয়েছে। তবে একদিনের বৃষ্টিতে ৩৬ হাজার ১৩৮ হেক্টর জমির চারা ধান নিমজ্জিত হয়েছে। এরমধ্যে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত ২০ হাজার ৯৪৫ হেক্টর জমি ও আংশিক নিমজ্জিত ১৫ হাজার ১৯৩ হেক্টর জমির ধান। এছাড়া এ মৌসুমে প্রায় ১১ হাজার হেক্টর জমিতে সবজির আবাদ করা হয়েছিল। বৃষ্টিতে প্রায় ৭২০ হেক্টর জমির সবজি আক্রান্ত হয়েছে।
আরও পড়ুন>> রাজশাহীর সড়কে জাল ফেলে মাছ ধরার উৎসব
গত ৫ অক্টোবর সারাদিনের বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় ময়মনসিংহ নগরীর রাস্তাঘাট। পানি ওঠে বাসাবাড়ি ও দোকানে। বাসায় পানি ওঠায় রাত কাটে নির্ঘুম। উপজেলাগুলোতে তলিয়ে যায়, ধান, পুকুর ও সবজির খেত। এতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েন কৃষকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মযমনসিংহ নগরীর গাঙ্গিনারপাড়, ধোপাখলা, চরপাড়া, নতুন বাজার, স্টেশন রোড, নয়াপাড়া, ব্রাহ্মপল্লি, কালিবাড়ি, গুলকিবাড়ি, আমলাপাড়া, ভাটিকাশরা, কালিবাড়িসহ নগরীর অনেক এলাকা হাঁটু ও কোমর সমান পানি জমে। এসব এলাকার বাসাবাড়ি ও দোকানে পানি ওঠে।
সেদিন রাত ১০ টার দিকে ময়মনসিংহ নগরীর কেওয়াটখালী এলাকার পাওয়ারগ্রিডের কন্ট্রোল রুমে পানি উঠে যায়। পরে খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তিন ঘণ্টায় কন্ট্রোল রুমের পানি সেঁচে বের করেন। এঘটনায় বেশ কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল। রাত দুইটার পর আবার কন্ট্রোল রুমে পানি জমে কেওয়াটখালী পাওয়ার গ্রিড বন্ধ হয়ে যায়।
আরও পড়ুন>> এক রাতের বৃষ্টিতে ডুবেছে ময়মনসিংহ নগরী
সিটি করপোরেশনের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের চর ঈশ্বরদিয়া এলাকায় অন্তত ৫০০ একর ধান ক্ষেত পানিতে তলিযে গেছে। ওই এলাকার কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, আমি ৮ কাঠা জমিতে ধান চাষ করেছিলাম। গত রাতের বৃষ্টির পানিতে সব ধানক্ষেত তলিয়ে গেছে।
একই এলাকার নেকবর মিয়া বলেন, আমি চার কাঠা জমিতে ধান চাষ করেছিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার সব পানিতে তলিয়ে গেছে।
সদর উপজেলার চর হরিপুর এলাকার বাসিন্দা সাদ্দাম হোসেন। তিনি বলেন, ১০ শতাংশের পুকুর ডুবে সব মাছ ভেসে গেছে। এতে ৫০ হাজার টাকার মাছ ভেসে গেছে।
একই এলাকার শামীম আহমেদ বলেন, আমার প্রায় ৩০ কাঠা ধানের জমি তলিয়ে গেছে। তবে আমার কোনো ফিসারি না থাকায় বেঁচে গেছি। তিনি বলেন, এই গ্রামে অন্তত ৩০০ একর জমির ধান তলিয়ে গেছে। বাড়ি ঘরেও পানি উঠেছে।
ওই এলাকার আব্দুর রহিম বলেন, বাড়ির চারপাশে অপরিকল্পিত পুকুর ও ফিসারি। এ কারণে বাড়ি ঘরে পানি উঠে গেছে। গরু ছাগল নিয়ে বিপাকে আছি।
লিপি আক্তার বলেন, এক রাতের বৃষ্টিতেই বাড়ি ঘর তলিয়ে গেছে। পরিবার নিয়ে খুব বিপদে আছি। চারপাশে অপরিকল্পিত ফিসারির কারণে আজ আমাদের এই দুর্দশা।
চর হরিপুর এলাকার জয়নাল বলেন, ১৭ কাঠা জমি লিজে নিয়ে ফিসারি দিয়েছি। এক রাতের বৃষ্টিতে সব তলিয়ে গেছে। মাছ যেন ফিসারি থেকে না যেতে পারে তাই নেট জাল দিয়ে বাঁধ দিচ্ছি। আমার অন্তত ১৫ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে।
চর হরিপুর গ্রামের মজিবুর রহমান বলেন, বৃষ্টি দেখেছি, কিন্তু এভাবে পানি জমতে দেখিনি কখনো। আমার ১০ কাঠা ধানের জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে ১২ কাঠা জমিতে ফিসারি ছিল। সব ফিসারি তলিয়ে গেছে। আমার অন্তত ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার মাছ চলে গেছে।
একই এলাকার মরম আলী বলেন, আমার ১৭ কাঠা ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। ১৫ কাঠা ফিসারির মাছ ভেসে গেছে। চর হরিপুর, বাজিতপুর ও আলালপুর গ্রামে অন্তত হাজার একর ফিসারি তলিয়ে গেছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা দীলিপ কুমার সাহা বলেন, এই বৃষ্টিতে অন্তত ২২ হাজার মৎস্য চাষি ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এ অর্থবছরে মৎস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে এটি বেশ প্রভাব ফেলবে। আমরা এরই মধ্যে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে হিসাব দিয়েছি।
ময়মনসিংহ কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মতিউজ্জামান বলেন, আমন ধানের মাঠ ও সবজিক্ষেত পানিতে নিমজ্জিত আছে। ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নির্ণয় করতে কাজ চলমান রয়েছে।
নগরীর জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা সংলগ্ন এলাকায় একটি বড় রেইন্ট্রি গাছের গোড়ার দিক থেকে বিশালাকৃতির ভাঙন তৈরি হয়েছে। বৃষ্টি বাড়লে ভাঙন বড় আকারে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ধসেপড়া অংশগুলো মেরামতে অন্তত কোটি টাকা লাগতে পারে।
ময়মনসিংহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আখলাক উল জামিল বলেন, বাঁধের ১৫টি অংশ ধসে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতির মাত্রা ও মেরামতের জন্য একটি প্রস্তাবনা তৈরি করে অনুমোদনের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে।
অন্যদিকে বৃষ্টিতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের কালভার্ট ও রাস্তার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জেলার ঈশ্বরগঞ্জে এলজিইডি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দপ্তরের অন্তত তিনটি কালভার্ট ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে প্রান্তিক এলাকার। এছাড়াও গফরগাঁও উপজেলার একটি কালভার্ট ধসে পড়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ছানোয়ার হোসেন বলেন, বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে সব এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তার তালিকা তৈরি করতে সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মাছ ধরতে গিয়ে প্রাণ গেছে তিনজনের
ময়মনসিংহে বৃষ্টিতে বহু মৎস্য খামারের মাছ বেরিয়ে গেছে। মাছচাষিদের কোটি কোটি টাকার মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে উন্মুক্ত পানিতে। এসব মাছ ধরতে গিয়ে পানিতে ডুবে জেলার ত্রিশালে দুজন ও ঈশ্বরগঞ্জে একজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হলেন ত্রিশাল উপজেলার কানিহারি উপজেলার তালতলা গ্রামের আবদুল কদ্দুস (৩৮), বালিপাড়া ইউনিয়নের আমিয়ান ডাঙ্গুরি গ্রামের গোলাম মোস্তফা মণ্ডলের ছেলে রিমন হোসেন মনা (৩৫) ও রাজিবপুর ইউনিয়নের ভাটিচর নওপাড়া গ্রামের বাচ্চু মিয়া (২৪)। এছাড়া বৃষ্টির দিন রাত ১২টার দিকে নগরীর ব্রাহ্ম্যপল্লি এলাকায় পলি (৬৫) নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে।
মঞ্জুরুল ইসলাম/এমএইচআর/জিকেএস