চলনবিলের শুঁটকিপল্লিতে নারী শ্রমিকদের বোবাকান্না
৬০ বছরের চায়না খাতুন। স্বামীকে হারিয়েছেন অনেক আগেই। অভাবের সংসারে ছেলে-মেয়েরাও ঠিকমতো খোঁজ নেয় না। এ অবস্থায় নিজের খাবার জোগাতে কাজ করছেন শুঁটকিপল্লিতে। তবে সারাদিন কাজ করে তিনি পান মাত্র ১৫০ টাকা। এনিয়ে খুব কষ্টে ও টানাপোড়েনের মধ্যে দিন কাটে বৃদ্ধা চায়নার।
শুধু চায়না নন, তার মতো সিরাজগঞ্জের চলনবিলের শুঁটকিপল্লিতে কাজ করেন কয়েক হাজার নারী শ্রমিক। তাদের প্রত্যেকের দৈনিক মজুরি ১৫০-২০০ টাকা, যা দিয়ে খুব কষ্টে চলে তাদের সংসার। অথচ শুঁটকিপল্লিতে পুরুষ শ্রমিকরাও একই কাজ করে মজুরি পান ৪০০ টাকা।
চায়না খাতুন বলেন, ৫ বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকেই চলনবিল অধ্যুষিত উল্লাপাড়া উপজেলার আড়ুয়া পাঙ্গাসী গ্রামের শুঁটকিপল্লিতে কাজ করেন। এখন তার বেঁচে থাকাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও দুবেলা দু’মুঠো ভাত খেতে বাধ্য হয়েই দিনমজুরের কাজ করেন।
উল্লাপাড়া উপজেলার লাহিড়ী মোহনপুর গ্রামের ফাতেমা খাতুন (৪৩) জাগো নিউজকে বলেন, প্রতিদিন সকাল ৭টায় কাজে আসি, ফিরি সন্ধ্যা ৬টায়। দৈনিক ১০ ঘণ্টা কাজ শেষে মজুরি পাই ১৫০ টাকা। এই টাকায় আসলে এখন আর সংসার চলে না। অথচ একই জায়গায় একই কাজ করে আমার পুরুষ সহকর্মীরা দৈনিক মজুরি পান ৪০০ টাকা করে।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে এমনই বৈষম্যের চিত্র দেখা যায় উল্লাপাড়া উপজেলার আড়ুয়া পাঙ্গাসী শুঁটকি পল্লির শাহ আলমের মাছ খোলায়।
সেখানেই কাজ করেন ২২ বছর বয়সী খুশি। তিনি বলেন, স্বামীর অভাবের সংসারের খরচ যোগাতে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করি। পাই মাত্র ১৫০ টাকা। কিন্তু আমাদেরই সমান কাজ করে একজন পুরুষ পান ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা।
মজুরির এমন বৈষম্য কেন, প্রশ্ন করলে কেউই কিছু বলতে চাননি। তবে এক নারী কর্মী বলেন, চলনবিলের শুঁটকির চাতালে এমন মজুরি বৈষম্য শুরু থেকেই। এটাই এখানকার নিয়ম। এর বাইরে কেউ কথা বললে কাজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। পেট চালানোর জন্য তাই এই অন্যায় মেনে নিয়েই কাজ করছি।
উল্লাপাড়া উপজেলার মৎস্য ব্যবসায়ী সাচ্চু মন্ডল জাগো নিউজকে বলেন, উল্লাপাড়া ও তাড়াশ উপজেলার প্রায় ৫০টি শুঁটকির চাতালে প্রায় ৩ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। যার ৬০ ভাগই নারী। তাদের মজুরি পুরুষের তুলনায় অনেক কম।
তিনি বৈষম্যের কথা স্বীকার করে বলেন, শুঁটকি পল্লির সব জায়গাতে একই রেট। কেউ কেউ অবশ্য ২০০ টাকাও দেয়। মূলত নারী শ্রমিক যেভাবে পাওয়া যায়, সেভাবে পুরুষ শ্রমিক পাওয়া যায় না। আবার পুরুষদের কাজ নারীদের চেয়ে এগিয়ে। তাই তাদের বাড়তি মজুরি দেওয়া হয়।
পাঙ্গাসী এলাকার শুঁটকি চাতালের মালিক কবির সেখ জাগো নিউজকে বলেন, আমার চাতালে ২০ জন নারী শ্রমিক প্রয়োজন হলেও প্রতিদিন ৪০ জন এসে কাজ করে। নিষেধ করলে বলে ভাই কাজ না করলে খাবো কী। এজন্য আমরা তাদের কম মজুরি দিয়ে থাকি।
সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহীনূর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, চলনবিলের শুঁটকির সুনাম ও চাহিদা দুটোই রয়েছে। ফলে আমরা এই শুঁটকির বাড়াতে চাতাল মালিকদের প্রশিক্ষণ দিই। জেলায় এবার প্রায় ৬০টি চাতালে ৩০২ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদন হয়েছে। যার বাজারমূল্য প্রায় ৮ কোটি টাকা। গত বছর উৎপাদন হয়েছিল ২৩৫ দশমিক ২৩ মেট্রিক টন। তবে এক্ষেত্রে নারীর অবদান উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এফএ/এমএস