আন্ধারমানিককে অন্ধকারে রেখেছে দেড় কিলোমিটার সড়ক
‘ভাই ছবি তুইল্যা লাভ নাই। আমাগো কারও লজ্জা নাই। এই সড়ক কেউ সারবো (মেরামত) না। এগুলো দেখার কেউ নাই।’ মানিকগঞ্জ পৌরসভার বেউথা-আন্ধারমানিক বেহাল সড়কের ছবি তোলার সময় প্রতিবেদককে ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন এক মোটরসাইকেল চালক। প্রতিবেদনের জন্য ঘণ্টাখানেক সেখানে অবস্থানকালে যানবাহনচালক, যাত্রী ও স্থানীয় বাসিন্দা সবার মাঝেই চরম ক্ষোভ আর হতাশা দেখা গেছে।
মানিকগঞ্জ শহরের বেউথা কালীগঙ্গা সেতু পার হওয়ার পরই বেউথা-আন্ধারমানিক সড়ক। মাত্র দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কটি দীর্ঘদিনেও সংস্কার না হওয়ায় যানচলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। খানাখন্দে ভরা সড়কে সামান্য বৃষ্টিতেই জমে হাঁটুপানি। বেহাল সড়কে চলতে গিয়ে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। সংস্কার নিয়ে পৌরসভা আর এলজিইডি বিভাগের ঠেলাঠেলিতে সড়কের এমন করুণ দশা বলে জানান স্থানীয়রা।
এলাকাবাসী জানায়, হেমায়েতপুর-সিংগাইর-মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক সড়ক হয়ে প্রতিদিন এই পথে আরিচা ও পাটুরিয়া ঘাটে যাতায়াত করে শতশত যানবাহন। পাশাপাশি জেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগে হরিরামপুর, ঘিওর ও শিবালয় উপজেলার হাজারো মানুষ চলাচল করেন। পাশেই রয়েছে মুন্নু মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও কানিজ ফাতেমা গার্লস হাইস্কুল। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটি সংস্কার করা হচ্ছে না প্রায় পাঁচ বছর ধরে।
সরেজমিন দেখা গেছে, বেউথা-আন্ধারমানিক সড়কের অন্তত সাতটি পয়েন্টে বড় বড় গর্ত হয়ে হাঁটু সমান পানি জমেছে। তার মধ্যেই চলাচল করছে যানবাহন। চোখের সামনে কয়েকটি অটোরিকশা উল্টে যাওয়ার উপক্রম হতে দেখা যায়। বড় দুর্ঘটনা থেকে বাঁচতে যাত্রীরা পানিতেই নেমে পড়েন। পানির মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে মোটরসাইকেলগুলো।
সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে কথা হয় কলেজছাত্র রাকিব হোসেনের সঙ্গে। তার ব্যান্ডেজ করা ডান হাত গলায় ঝোলানো। জানালেন, ভাঙাচোরা এই সড়কে চলতে গিয়ে গত সপ্তাহে মোটরসাইকেল থেকে পড়ে তার ডান হাত ভেঙে যায়। এক সপ্তাহ হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর আজই তিনি বাসায় ফিরছেন। দুর্ঘটনার কারণে অনার্স পরীক্ষায় তিনি অংশ নিতে পারেননি। তার মতো দুর্ঘটনায় প্রায়ই কারও হাত অথবা পা ভাঙছে সড়কে।
মোটরসাইকেলচালক আবির হোসেন বলেন, এই রাস্তায় আমাদের দুর্ভোগের শেষ নাই। রাস্তাকে এখন জাহান্নাম মনে হয়। আমি ১০ বছর ধরে মোটরসাইকেল চালাই। কোথাও অ্যাক্সিডেন্ট না করলেও এই সড়কে তিনবার পড়ে গেছি। প্রতিদিনই দেখি অটোরিকশা অথবা ট্রাক উল্টে পড়ে আছে। তারপরও কারও কোনো মাথা ব্যথা নাই।
অটোরিকশাচালক রহিম মিয়া বলেন, প্রতিদিন শত শত গাড়ি চলে এই সড়কে। ভাঙাচোরা রাস্তায় চলতে গিয়ে যাত্রীর ক্ষতি, আমাদেরও ক্ষতি। গাড়ি প্রায়ই বিকল হয়। মানুষের হাত-পা ভাঙে। কিন্তু এই বিপদ থেকে আমরা কীভাবে রক্ষা পাবো, সেটাই জানা নেই। এই সড়ক দেখবো কে?
ক্ষোভ ছাড়লেন ট্রাকচালক হারুন মিয়াও। তিনি বলেন, এই সড়ক দিয়ে কি গাড়ি চালানো যায়? ট্যাক্স-ভ্যাট সবকিছুই তো সরকার বাড়াইছে। কিন্তু আমাদের কী সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে?
স্থানীয় বাসিন্দা রহিম উদ্দিন বলেন, এই রাস্তার কোনো বাপ-মা নাই ভাই। কেউ ঠিক করে না। এই রাস্তা পৌরসভা কয় এলজিইডির। আর এলজিইডি কয় পৌরসভার। তারা ঠেলাঠেলি করছে। জনগণ কই যাইবো। এই দেশে সবারই ঐক্য আছে শুধু জনগণের ঐক্য নাই।
তিনি বলেন, গ্রামটির নাম যেমন আন্ধারমানিক। যেন অন্ধকারের মধ্যেই আছে সবাই। কোনো আলো নাই। শিশু ও বৃদ্ধরা বাড়ির সামনের রাস্তায় বের হতে পারে না।
করিম মিয়া নামে একজন বলেন, দেড় কিলোমিটার রাস্তা। হোক পৌরসভার বা এলজিইডির। বিষয়টা হলো মানুষের জন্য আইন। আইনের জন্য তো মানুষ না। এই রাস্তাটা সবার জন্যই সমস্যা হচ্ছে। দ্রুত এটি মেরামত হওয়া দরকার।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেউথা-আন্ধারমানিক সড়কের দেড় কিলোমিটার অংশ পৌরসভার মধ্যেই অবস্থিত। কালীগঙ্গা নদীর ওপর বেউথা সেতু হওয়ার আগে সড়কটি পৌরসভায় সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করতো। কিন্তু বেউথা সেতু নির্মাণ করে এলজিইডি বিভাগ। সেসময় এলজিইডি সড়কটি সংস্কার করে। এছাড়া বেউথা-আন্ধারমানিক সড়কটি মিশেছে এলজিইডির আরেকটি সড়কের সঙ্গে। যে কারণে মাঝের এই অংশটুকু মেরামতে পৌর কর্তৃপক্ষ গড়িমসি করে আসছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মানিকগঞ্জ পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. বেল্লাল হোসেন বলেন, সড়কটি এলজিইডি দেখভাল করে। তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারাই এটির সংস্কার করবে।
মানিকগঞ্জ এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফয়জুল হক বলেন, সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে একেকটি সংস্থার একেকটি জুরিডিকশন (আইনগত অধিকারের ব্যাপ্তি বা সীমা) আছে। পৌরসভার জুরিডিকশন পৌরসভার অংশটুকু। ওই অংশটুকু অন্য কোনো সংস্থা বাস্তবায়ন করতে পারে না। বেউথা ব্রিজটি যখন নির্মাণ করা হয় তখন অ্যাপ্রোচ রোড হিসেবে সড়কটি একবার এলজিইডি সংস্কার করেছিল। এরপর আর কাজ হয়নি। যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে তাই রাস্তাটি নিয়ে জনসাধারণ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সড়কটি মেরামতে পৌরসভার বাজেট না থাকার কারণে তাদের অনুরোধে সংস্কারে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রায় দেড় কিলোমিটার সড়কের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। যার প্রাক্বলিত মূল্য ২ কোটি ৯০ লাখ টাকা। দরপত্র অনুমোদন হওয়ার পরে চুক্তিমূল্য নির্ধারণ করা হবে।
এমআরআর/জেআইএম