শেরপুরের সব স্কুল-কলেজের ওয়েবসাইট অচল, গচ্চা অর্ধকোটি টাকা
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী নিজ প্রতিষ্ঠানের ডাইনামিক ওয়েবসাইট করতে গিয়ে প্রায় অর্ধকোটি টাকা গচ্চা গেছে শেরপুরের দুই শতাধিক স্কুল-কলেজের। ভুয়া প্রতিষ্ঠান থেকে কাজ করানোয় ওয়েবসাইটগুলো অচল হয়ে পড়ে আছে।
সম্প্রতি আবারও ওয়েবসাইট নির্মাণ ও হালনাগাদে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হলে বিভিন্ন নাম সর্বস্ব আইটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে চটকদার বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। তবে এবার প্রতারণা এড়াতে অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে সহায়তা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন শিক্ষা কর্মকর্তা।
জানা গেছে, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী সই করা গত ১৯ আগস্টের একটি নির্দেশনা নিয়ে স্কুল ও কলেজে যাচ্ছে বিভিন্ন নামি-বেনামি আইটি প্রতিষ্ঠান। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে একটি ডোমেইন কিনে, পূর্ব নির্মিত ফ্রেম (রেডি টেমপ্লেট) ব্যবহার করে মাত্র একদিনেই ওয়েবসাইট ডেলিভারি দেওয়া হচ্ছে। অথচ সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ওয়েবসাইটে প্রতিষ্ঠান পরিচিতি, পাঠদানের অনুমতি ও স্বীকৃতি, শ্রেণি ও লিঙ্গভিত্তিক শিক্ষার্থীদের তথ্য, রুটিন, নোটিশ, পাঠ্যসূচি ও ফল সংগ্রহের ব্যবস্থা থাকার কথা থাকলেও তার কিছুই থাকছে না এসব নামমাত্র ওয়েবসাইটে। অদক্ষ এসব আইটি উদ্যোক্তাদের কারণে এবারও টাকা গচ্চা যাওয়ার শঙ্কায় স্থানীয় শিক্ষকরা।
এদিকে, গেলো ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ওয়েবসাইটের ঠিকানা মাউশি দপ্তরে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়ার পর থেকেই ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক থেকে পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট করে দেওয়ার বিজ্ঞাপনও দেওয়া হচ্ছে। আইটি উদ্যোক্তারা বলছেন, বিটিসিএলের নির্দেশনা ও মূল্য অনুযায়ী সরকার নিবন্ধিত একটি ডোমেইনের মূল্য যেখানে দুই হাজার টাকার ওপরে, সেখানে এত কম টাকায় মানসম্মত ওয়েবসাইট তৈরি সম্ভব না। টাকা বাঁচাতে গিয়ে এসব বেনামি প্রতিষ্ঠান থেকে ওয়েবসাইট নির্মাণ করলে আবারও লোকসানের মধ্যে পড়তে হবে শিক্ষকদের।
প্রিয় শিক্ষালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও আইটি উদ্যোক্তা মহিউদ্দিন সোহেল বলেন, একটি সরকারি নির্দেশনার পর অনেক বেনামি ও নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের স্কুল ও কলেজের কাজ করিয়ে দেওয়ার কথা বলে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এসব ভুয়া প্রতিষ্ঠানের খপ্পরে যাতে কেউ না পড়ে, সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।
বিডি আইটি জোনের প্রধান নির্বাহী ইফতেখার পাপ্পু বলেন, আমরা গতবারও দেখেছি, সরকারি প্রজ্ঞাপন নিয়ে শিক্ষকদের বোকা বানিয়ে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ভুয়া প্রতিষ্ঠানগুলো। এবার যাতে কেউ প্রতারিত না হয়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
শেরপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের চলতি শিক্ষাবর্ষের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচির মলাটে প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটের ঠিকানা দেওয়া থাকলেও তা অচল। ঝিনাইগাতী মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ডাইনামিক ওয়েবসাইটও অচল। শুধু এই দুটিই নয়; শেরপুরের ২১০টি স্কুল ও কলেজের মধ্যে দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট এখন অচল। অথচ ২০১৫ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের এক পরিপত্র অনুযায়ী সব প্রতিষ্ঠান প্রধানরা তাদের ওয়েবসাইট নির্মাণ করেছিলেন।
শিক্ষকদের অভিযোগ, সেসময় নামে-বেনামে বিভিন্ন আইটি প্রতিষ্ঠান থেকে সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে ওয়েবসাইট নির্মাণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ওইসব ভুয়া আইটি প্রতিষ্ঠানের খোঁজ না থাকায় মুখ থুবড়ে পড়ে উদ্যোগটি। আবার স্কুলে দক্ষ জনবল না থাকায় হালনাগাদও করা সম্ভব হয়নি ওয়েবসাইট। এদিকে, ওইসব আইটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দুই বছর পর ডোমেইন পুনঃনিবন্ধন না করায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট একেবারেই বাদ হয়ে যায়।
শেরপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা এ্যানি সুরাইয়া মিলোজ বলেন, ওই সময় নির্দেশনা অনুযায়ী একটি ওয়েবসাইট করা হলেও দক্ষ জনবল না থাকায় ওয়েবসাইটের হালনাগাদ করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ডোমেইন রিনিউ করা যায়নি। এজন্য ওয়েবসাইট চলমান ছিল না। আমরা চলতি বছর নির্দেশনা অনুযায়ী আবারও ওয়েবসাইটের নির্মাণ কাজ শুরু করেছি। আশা করছি, এবার সব ঠিকঠাক হবে।
স্কুল-কলেজের নিজস্ব ওয়েবসাইট থাকলে বিভিন্ন সুবিধা মিলবে। শিক্ষার্থী হাজিরা, রুটিন ও ফল দেখা যাবে ঘরে বসেই। বেতনও দেওয়া যাবে অনলাইনে। শিক্ষার্থী সুমাইয়া আফরিন বললো, আমাদের বিদ্যালয়ের একটি ওয়েবসাইট থাকলে বাবা-মা ঘরে বসেই রেজাল্ট, দৈনিক হাজিরা, মাসিক বেতনের বিষয়টি দেখতে পারতেন। আমাদের কাজ আরও অনেক সহজ হতো।
শিক্ষার্থী মিলন ফারাবী বললো, স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় একটি বিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থাকা খুবই জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভুয়া ও বেনামি প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা এড়াতে দক্ষ জনবলের মাধ্যমে কাজ করানো উচিত। শেরপুর মডেল গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ তপন সারোয়ার বলেন, কেউ যাতে এবার প্রতারিত না হন, সে বিষয়ে সবাইকেই সচেতন থাকতে হবে। দক্ষ প্রতিষ্ঠান ছাড়া কেউ যাতে কাজ না করে, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
এদিকে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রেজুয়ান বলছেন, প্রতারণা এড়াতে পরিচিত প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নিতে পারলে ভালো হবে। স্থানীয় আইটি উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে সেবা নিলে পরবর্তীতে দ্রুত সেবা পাওয়া সম্ভব হবে। এছাড়া ওয়েবসাইট নিয়মিত হালনাগাদ রাখতে স্কুল-কলেজের সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
জেলা শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, শেরপুরে মাধ্যমিক স্কুল রয়েছে ১৮০টি ও কলেজ রয়েছে ৩০টি। গেলো ২০১৫ সালের নির্দেশনা অনুযায়ী গড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকায় ওয়েবসাইট নির্মাণ করলে প্রায় ৫০ লাখ টাকা বা তারও বেশি গচ্চা গেছে শেরপুরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর। তাই এবার যাতে কেউ প্রতারিত না হন, সে বিষয়ে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান সংশ্লিষ্টদের।
এমআরআর/জেআইএম