ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

অপচিকিৎসার জালে বন্দি উপকূলের জেলেরা

আব্দুস সালাম আরিফ | প্রকাশিত: ১১:০১ এএম, ২৪ আগস্ট ২০২৩

এখনো বিভিন্ন অপচিকিৎসার ওপর নির্ভরশীল পটুয়াখালীসহ উপকূলীয় এলাকার জেলে ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। তাইতো জটিল ও স্পর্শকাতর বিভিন্ন রোগ নিয়েও তারা ওঝা কিংবা কবিরাজের শরণাপন্ন হন। এতে জটিল সব রোগাক্রান্ত হওয়ার পাশিপাশি অনেকে দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক জটিলতায় ভোগেন। তবে এসব বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে জেলেদের সচেতন করা কিংবা জেলেদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতের বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না।

উত্তাল সমুদ্রে মাছ শিকারের পর যখন মৎস্য বন্দরগুলোতে জেলেরা ট্রলার কিংবা নৌকা নোঙর করেন, সেসময় তাদের সাধারণত বিভিন্ন রোগ কিংবা শারীরিক সমস্যার চিকিৎসা করানো হয়। আর এটাকেই পুঁজি করে মৎস্য বন্দরকেন্দ্রিক বিভিন্ন কবিরাজি ও অপচিকিৎসার নামে সেবার পসরা সাজিয়ে বসেন ওঝা ও কবিরাজসহ হাতুড়ে ডাক্তাররা। যাদের নেই কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা প্রশিক্ষণ। এরপরও বছরের পর বছর তারা এই কাজ করছেন।

সম্প্রতি কলাপাড়া উপজেলার আলীপুর মৎস্য বন্দরে গিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েকজন লোক বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নিয়ে জেলেদের কানের চিকিৎসা করছেন। মাথায় লাগানো ছোট আকৃতির লাইট জ্বালিয়ে এবং হাতে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নিয়ে খোলা স্থানেই জেলেদের কানের চিকিৎসা করছেন তারা।

নাম প্রকাশ না করলেও এসব কথিত চিকিৎসকরা বলছেন, তারা জেলেদের কান থেকে ময়লা বের করেন। এতে করে জেলেরা কিছুটা হলেও আরাম বোধ করেন। কানের সব চিকিৎসা করতে পারেন বলেও দাবি এসব হাতুড়ে ডাক্তারের।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত কয়েক দশক যাবত এই এলাকায় বিভিন্ন ধরনের অপচিকিৎসা চলছে। বিশেষ করে স্থানীয় জেলে, কৃষক ও নিম্ন আয়ের মানুষকে টার্গেট করেই তারা এ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব কথিক কবিরাজ ও চিকিৎসকরা বিভিন্নভাবে মানুষের কাছ থেকে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেন। এরপর চিকিৎসার নামে পয়সা হাতিয়ে নেন।

অবাক করার বিষয় হলো- আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রে মানুষের রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা-নীরিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও এসব কথিত চিকিৎসকরা খালি চোখেই ‘রোগ নির্ণয়’ করছেন। চিকিৎসকরা নির্দিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হলেও এসব ওঝা ও কবিরাজ একাই সব ধরনের রোগের চিকিৎসা করছেন। যেমন- মাথার চুল পড়া থেকে শুরু করে হাত-পা ভাঙা, চর্ম, যৌন, পেটব্যথা, নারীদের বিভিন্ন গোপন রোগ, দাঁতের চিকিৎসা, চোখের চিকিৎসা, আগুনে পোড়া থেকে শুরু করে সব চিকিৎসাই হয় তাদের কাছে।

আলীপুর মৎস্য বন্দরের জেলে ইদ্রিস মিয়া বলেন, ‘আমরাতো আর ভালো ডাক্তারের কাছে যাইয়া চিকিৎসা করাইতে পারি না, আমাগো হেইরোম টাহাও নাই, আর সময়ও পাই না। হেইতে আইজ কান দেহাইলাম। কানের মধ্যে ভোন ভোন শব্দ পাইতাম। উনি পরিষ্কার কইরা দিছে, এখন একটু ভালো বুঝি।’

একই বন্দরের জেলে আবুল হোসেন বলেন, ‘আমরা কী করমু? কুয়াকাটায় একটা হাসপাতাল আছে কিন্তু হেহানে কোনো ভালো ডাক্তার নাই। এহানে ডাক্তার থাকলেওতো হেইগহানে যাইতাম। হেই কারণে এই কবিরাজি আর বোনাজি ডাক্তার দেহাই।’

আলীপুর মৎস্য বন্দরে কথা হয় আরও বেশ কয়েকজন জেলের সঙ্গে। কুয়াকাটার মিশ্রিপাড়া এলাকার বাসিন্দা সিদ্দিক মাঝী বলেন, ‘আমরা সব রোগের চিকিৎসা হাতুড়ে ডাক্তার দিয়েই করি। কয়েকদিন আগে আমার ডান পাশের মাড়ির একটি দাঁতে অনেক ব্যথা হচ্ছিল। এরপর এক কবিরাজের কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়ে এখন ভালো আছি। এছাড়া গত বছর পায়ে ঘাঁ হয়েছিল, সেটারও কবিরাজের কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়েছি।’

আলীপুর মৎস্য বন্দরে ‘মানব সেবার দাওয়াই খানা’ নামে একটি ভ্রাম্যমাণ প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছেন মো. দুদু মিয়া নামে এক ব্যক্তি। নিজেকে তিনি কবিরাজ পরিচয় দিলেও তার নেই কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা। তবে তিনি দাবি করেন পারিবারিকভাবেই তিনি কবিরাজি চিকিৎসার জ্ঞান লাভ করেছেন। তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলায়।

দুদু মিয়া বলেন, ‘আমি সব ধরনের রোগের চিকিৎসা করি। অর্শ, পাইলস, অ্যালার্জিসহ সব চর্মরোগের চিকিৎসা এখানে হয়। এছাড়া নারীদের সাদাশ্রাব, ঘন ঘন প্রস্রাব, জরায়ুতে টিউমারসহ বিভিন্ন যৌন রোগের চিকিৎসা করা হয় এখানে। আর এসব চিকিৎসায় বিভিন্ন গাছ-পালা ব্যবহার করা হয়্য। এতে কোনো কেমিকেল ব্যবহার করা হয় না।’

তার এই চিকিৎসার জন্য সরকারি কোনো অনুমোদন নেই বেলও স্বীকার করেন দুদু মিয়া। তবে তিনি দাবি করেন, তিনি যেখানে চিকিৎসা দেন সেই এলাকার ট্রেড লাইসেন্সের ভিত্তিতে তিনি প্রতিষ্ঠানটি চালান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পটুয়াখালীর সিভিল সার্জন ডা. এস এম কবির হাসান বলেন, এ ধরনের চিকিৎসা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক এবং ঝুঁকিপূর্ণ। রাস্তাঘাটে এমন অপচিকিৎসার কারণে জটিল সব সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে চোখ-কানের মতো স্পর্শকাতর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের এ ধরনের চিকিৎসা করার কোনো সুযোগ নেই। আমরা এ বিষয়ে জেলেদের সচেতন করার পাশপাশি যারা এই অপচিকিৎসা চালাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

এফএ/এএসএম