ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

খুঁড়িয়ে চলছে রিকশাচালকের ‘মমতাজ হাসপাতাল’

মঞ্জুরুল ইসলাম | ময়মনসিংহ | প্রকাশিত: ০৮:১৫ এএম, ২৪ আগস্ট ২০২৩

রিকশাচালক জয়নাল আবেদীন। বাবা আব্দুল গণি যক্ষ্মা আক্রান্ত হয়ে মারা যান বিনা চিকিৎসায়। সেই কষ্ট থেকে তৈরি হয় ক্ষোভ। হাসপাতাল স্থাপনের পরিকল্পনা করেন জয়নাল আবেদীন। রিকশা চালিয়ে তৈরি করেন হাসপাতাল। নাম দেন ‘মমতাজ হাসপাতাল’।

পরে তৈরি করেন প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মসজিদ। এসব কারণে জয়নাল আবেদীনকে ‘সাদা মনের মানুষ’ ঘোষণা করা হয়, দেওয়া হয় সম্মাননা। ২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি তিনি মারা যান। তবে সাদা মনের জয়নাল মারা যাওয়ার পর কেউ খোঁজ নেননি তার হাসপাতালের। সুইডেন প্রবাসী ছেলের পাঠানো টাকায় কোনোমতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে ‘মমতাজ হাসপাতাল’।

রিকশাচালক জয়নাল আবেদীন ময়মনসিংহ সদর উপজেলার পরানগঞ্জ ইউনিয়নের টান হাসাদিয়া গ্রামের কৃষক আবদুল গণির ছেলে। জয়নাল আবেদীনরা ছিলেন পাঁচ ভাই। তাদের মধ্যে জয়নাল সবার ছোট। জয়নাল আবেদীনের ছেলে জাহিদ হাসান সুইডেন প্রবাসী। মেয়ে মমতাজের নামে হাসপাতালটির নামকরণ করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: ডিমও ভাগ করে খাচ্ছেন মেসের শিক্ষার্থীরা

২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ‘এসো বাংলাদেশ গড়ি’ শীর্ষক রোড-শো চলাকালে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জয়নাল আবেদীনকে ‘সাদা মনের মানুষ’ সম্মাননা ও পদক দেওয়া হয়। ২০১১ সালের ১৯ নভেম্বর ৪০তম জাতীয় সমবায় দিবসে সংবর্ধনা দেওয়া হয় তাকে।

যেভাবে মমতাজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা

১৯৭৪ সালে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমান জয়নাল আবেদীন। ঢাকায় এসে ক্লিনিকে আয়ার কাজ নেন স্ত্রী লাল বানু। আর জয়নাল রিকশা চালাতে শুরু করেন। অল্প অল্প করে জমাতে থাকেন টাকা। ২০০১ সালে দুই লাখ ৭৪ হাজার টাকা জমিয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন। তখন ২৪ শতাংশ জমি ৪০ হাজার টাকায় কিনে ছোট একটি আধাপাকা টিনশেড ঘর তৈরি করেন। সেই ঘরে নিজের মেয়ে মমতাজের নামে শুরু করেন হাসপাতালের কার্যক্রম। টিনশেড থেকে সেটি পরে আধাপাকা ভবনে রূপান্তর করা হয়।

হাসপাতাল ছাড়াও গ্রামের ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ২০০৮ সালে নিজের ৩৩ শতক জমিতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন রিকশাচালক জয়নাল আবেদীন, যা পরবর্তীসময়ে ২০১৬ সালে সরকারি করা হয়। তবে, বিদ্যালয়টি সরকারি হলেও জয়নাল আবেদীনের পরিবারের কেউই বিদ্যালয়ে চাকরি পাননি।

আরও পড়ুন: কোটি কোটি টাকা খুইয়ে বিনিয়োগকারীদের বোবা কান্না

হাসপাতাল ও বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর নিজের জায়গায় একটি মসজিদ তৈরির কাজে হাতে দেন। তবে, মসজিদ নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার আগেই ২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি ‘সাদা মনের মানুষ’ জয়নাল মারা যান।

সরেজমিনে যা দেখা গেলো

হাসপাতালটি আধাপাকা ভবন। হাসপাতালের পুরুষ ও নারী ওয়ার্ডে তিনটি করে ছয়টি শয্যা রয়েছে। জরুরি রোগীকে স্যালাইন দেওয়ার জন্য শয্যাগুলো ব্যবহার করা হয়। তবে এখানে রোগী ভর্তি করে রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও আন্তঃবিভাগ সেবা চালু থাকলেও এখন সব বন্ধ হওয়ার পথে। জয়নাল আবেদীন মারা যাওয়ার আগে সপ্তাহের প্রতিদিন চিকিৎসা কার্যক্রম চালু থাকলেও বর্তমানে শনি, সোম ও বুধবার হাসপাতালের সেবা চালু রয়েছে। কোনো সহায়তা না পাওয়ায় রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়া বন্ধ।

২০০১ সালে হাসপাতালের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সাত বছর বিনা বেতনে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন স্থানীয় পল্লিচিকিৎসক আলী হোসেন। বর্তমানে মাসে পাঁচ হাজার টাকা সম্মানীতে সেবা দিচ্ছেন তিনি। ২০১৪ সালে দুই হাজার টাকা সম্মানীতে আকলিমা আক্তার নামের একজনকে ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দেওয়া হয়। একজন ক্লিনার রাখা হয়েছে। তার মাসিক বেতন সাত হাজার টাকা। জয়নাল আবেদীন মারা যাওয়ার পর থেকে মমতাজ হাসপাতালের পরিচালনায় রয়েছেন তার পুত্রবধূ আল্পনা জেরিন।

আরও পড়ুন: সুখ ফিরেছে উপহারের ঘরে

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, প্যাসিফিক ফার্মাসিউটিক্যালস নামের একটি ওষুধ কোম্পানি হাসপাতালে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকার ওষুধ ও নগদ ১০ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান দিতো। তবে জয়নাল আবেদীন মারা যাওয়ার পর বন্ধ হয়ে গেছে ওষুধ কোম্পানির অনুদান। এ কারণে রোগীপ্রতি ১০ টাকা ফি ও সুইডেন প্রবাসী ছেলে জাহিদ হাসানের পাঠানো টাকায় কোনোমতে চলছে হাসপাতালটি।

হাসপাতালে কথা হয় চিকিৎসা নিতে আসা বৃদ্ধা রয়তন বেগমের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘জয়নাল আবেদীন বেঁচে থাকতে হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে ওষুধ ও সেবা পেতাম। এখন টিকিট কেটে ডাক্তার দেখাতে হয়। ওষুধ আগের মতো দেয় না। যদি সরকার এ হাসপাতালে সহায়তা করতো তাহলে আমরা ইউনিয়নের মানুষ ভালো চিকিৎসা পেতাম।’

বৃদ্ধা জানু বেগম বলেন, ‘গ্রামে আমাদের মতো গরিব ও অসহায় মানুষের জন্য এ হাসপাতালটিই ছিল ভরসা। সাদা মনের মানুষ জয়নাল আবেদীন মারা যাওয়ার পর সব সহায়তা বন্ধ হয়ে গেছে। যে কারণে আমরা আগের মতো ওষুধ পাচ্ছি না।’

হাসপাতালটির চিকিৎসক আলী হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি হাসপাতালটিতে ২০০১ সাল থেকেই রোগীদের সেবা দিয়ে আসছি। আগে কিছু ওষুধ কোম্পানি হাসপাতালটিতে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করতো। জয়নাল আবেদীন চাচা মারা যাওয়ার পর এখন বন্ধ। কোম্পানিগুলো আগের মতো ওষুধ দিলে অসহায়-গরিব রোগীদের উপকার হতো।’

আরও পড়ুন: গৌড়মতি নিয়ে দিশেহারা বাগানিরা

কথা হয় প্যাসিফিক ফার্মাসিউটিক্যালসের ময়মনসিংহ ডিপো ইনচার্জ সুকমল রায়ের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মমতাজ হাসপাতালে সহায়তা দেওয়া বন্ধ। এ সহায়তা চালু হবে কি না তা আমার জানা নেই।’

মমতাজ হাসপাতালের পরিচালক আল্পন জেরিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি শ্বশুরের এ হাসপাতালের স্মৃতিটুকু ধরে রাখতে চাই। শ্বশুর জীবিত থাকতে বিভিন্ন জায়গা থেকে মাসে মাসে সহায়তা আসতো। তিনি মারা যাওয়ার পর এসব সহায়তা বন্ধ। আগে প্যাসিফিক ফার্মাসিউটিক্যালস থেকে কিছু ওষুধ ও নগদ টাকা সহায়তা করা হতো। ৭-৮ মাস ধরে সেটাও বন্ধ। এখন আমাদের চালাতে কষ্ট হচ্ছে।’

তিনি বলেন, আগে রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়া হতো। কোনো সহায়তা না পাওয়ায় এখন রোগীদের কাছ থেকে ১০ টাকা ফি নেওয়া হচ্ছে। আমার স্বামী বিদেশ থেকে মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠায়। সেই টাকা দিয়ে হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীদের কিছু ওষুধ, হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক ও অন্যদের বেতন দেওয়া হয়।’

এ বিষয়ে জেলা সিভিল সার্জন ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালটির বিষয়ে আমার জানা নেই। তবে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি বরাবর আবেদন করলে হাসপাতাল সম্পর্কে জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এসআর/এএসএম